
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ৯ মাস পর দেশ ছেড়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ। বুধবার রাতে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে থাই এয়ারের একটি ফ্লাইটে তিনি থাইল্যান্ডে যান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর কিশোরগঞ্জে দায়ের করা একটি হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি ছিলেন আবদুল হামিদ। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকা আবদুল হামিদকে ফ্যাসিবাদের অন্যতম অংশীদার দাবি করে তার দেশত্যাগের সুযোগ দেয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন পক্ষ। যারা তাকে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তোলা হয়েছে। দিনভর এমন প্রতিক্রিয়া আসায় গতকাল রাতে এ ঘটনায় জড়িত পুলিশের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তথ্য জানানো হয়। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী দিনাজপুরে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আব্দুল হামিদের দেশত্যাগে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে, ব্যবস্থা না নিতে পারলে তিনি নিজেই দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাবেন।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, বুধবার রাত ৩টা ৫ মিনিটে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে রওনা করেন তিনি। এসময় সঙ্গে ছিলেন তার ছোট ছেলে রিয়াদ আহমেদ তুষার ও শ্যালক ডা. আ. ন. ম. নৌশাদ খান। পরিবারের দাবি বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ থাকা সাবেক এই প্রেসিডেন্ট চিকিৎসা সেবা নিতেই মাঝরাতে ঢাকা ছাড়েন। তবে তার এই দেশত্যাগকে ঘিরে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। আবদুল হামিদের দেশত্যাগের খবরে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বুধবার রাত ১১টার দিকে মুখে মাস্ক ও মাথায় টুপি পরে ছেলে ও শ্যালককে সঙ্গে নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মতোই ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছান আব্দুল হামিদ। ইমিগ্রেশনে প্রবেশের পর প্রথম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এয়ারপোর্টের দায়িত্বে থাকা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সদস্যরা। তার বিরুদ্ধে আদালতের ও কোনো গোয়েন্দা বাহিনীর নিষেধাজ্ঞা না থাকায় তার বহির্গমনে গ্রীন সিগন্যাল দেয়া হয়। সবশেষ যাচাই-বাছাই শেষে রাত ৩টা ৫ মিনিটে থাই এয়ারওয়েজের ‘টিজি-৩৪০’ নম্বর ফ্লাইটে চেপে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে রওনা করেন তিনি।
বিষয়টি নিশ্চিত করে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ দেশত্যাগ করেছেন এটা সত্য। ‘তার নামে কিশোরগঞ্জ সদর থানায় মামলা রয়েছে, এরপরও তিনি কীভাবে ক্লিয়ারেন্স পেলেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে এটা সঠিক। কিন্তু কারোর নামে মামলা থাকলেই যে সে বিদেশে যেতে পারবেন- না এটা ঠিক না। মূলত যাদের মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে দেশত্যাগে আদালত নিষেধাজ্ঞা দেন বা কোনো গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আমাদের কাছে কারোর বহির্গমনে নোটিশ করা হয় তাদেরকেই আমরা বাধা দিয়ে থাকি। আব্দুল হামিদের ক্ষেত্রে এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সংবিধানের ৩৬ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘আইন মোতাবেক বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, এর যেকোনো স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।’ তাই সংবিধানের ৩৬ ও ৩৭ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশি কোনো নাগরিককে যাতায়াতে বাধা দেয়া যাবে না। যদি আদালতের সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা না থাকে। তার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। কোনো মামলায় তাকে আটক বা গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকেও কোনো আর্জি বা আবেদন ছিল না। ‘তাহলে জুলাই বিপ্লবের পরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগসহ যাদের বিমানবন্দর থেকে আটক করা হলো, তাদের নামে কী আদালতের নিষেধাজ্ঞা ছিল?’-এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, অবশ্যই ছিল। যাদের আমরা বিমানবন্দর থেকে আটক করেছি তাদের সকলের বিষয়েই আমাদের কাছে তথ্য ছিল। কিন্তু আব্দুল হামিদের নামে এমন কিছুই ছিল না। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ইমিগ্রেশন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের শিফট-১ এর দায়িত্বে থাকা বিশেষ পুলিশ সুপার বলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যাংককে গিয়েছেন। আমরা তার ভিসা ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেছি।
সাবেক প্রেসিডেন্ট পরিবারের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ৫ই আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আব্দুল হামিদ তার নিকুঞ্জের বাসভবন ছেড়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসভবনে বসবাস করে আসছিলেন। সমপ্রতি তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ঢাকার একটি হাসপাতালে তাকে চিকিৎসাও দেয়া হয়। আব্দুল হামিদের সঙ্গে ব্যাংকক যাওয়া ছোট ছেলে ব্যারিস্টার রিয়াদ আহমেদ তুষার ঈশা খাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। তিনি ইসলামী সমাজ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। আব্দুল হামিদের শ্যালক অধ্যাপক ডা. আ. ন ম নৌশাদ খান জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি। তিনি প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও ঈশা খাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান। ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও গুলির ঘটনায় কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে।
এদিকে গত ১৪ই জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে তহমুল ইসলাম মাজাহারুল নামে একজন একটি মামলা করেন। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩/৪ ও পেনাল কোডের ১৪৩/৩২৬/১১৪/৩৪ ধারার ওই হত্যাচেষ্টা মামলার ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ২ নম্বর আসামি শেখ রেহানা ও মামলাটির ৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে আব্দুল হামিদকে। মামলাটির আসামির তালিকায় মোট ১২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও আরও ২০০/২৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
মামলার বিষয়ে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন মানবজমিন’কে বলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে আমাদের থানায় একটি মামলা রজ্জু হয়। তবে মামলাটি কোনো হত্যা মামলা না। ভিকটিম নিজে বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন।
ওদিকে আব্দুল হামিদের দেশত্যাগের বিষয়ে বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এ ঘটনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ।