
সিএনজি (রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস) ফিলিং স্টেশন থেকে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে বিক্রি করা হচ্ছে। সিএনজি স্টেশন থেকে শুধু যানবাহনে গ্যাস সরবরাহের কথা। অথচ যানবাহনের জন্য নির্ধারিত গ্যাস সিলিন্ডারে ভরে ভ্যান, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে করে দূর-দূরান্তের শিল্প-কারখানা ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে যেকোনো সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
সরেজমিনে বেশ কিছু সিএনজি স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, দীর্ঘ লাইন দিয়ে অপেক্ষা করলেও যানবাহনে গ্যাস সরবরাহ না করে দেওয়া হচ্ছে কারখানার সিলিন্ডারবাহী কাভার্ড ভ্যানে। গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকার সিএনজি স্টেশনে অবৈধভাবে গ্যাস দেওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিষয়টি অবৈধ জেনেও বাড়তি মুনাফা করতে গ্যাসের সংকটের কথা বলে অনেক সিএনজি স্টেশন থেকে যানবাহন ফেরত দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম ৪৩ টাকা। কিন্তু অবৈধভাবে এসব গ্যাস সিলিন্ডারে প্রতি ঘনমিটার ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
সিএনজি স্টেশন মালিকরা বলছেন, বর্তমানে শিল্প-কারখানায় ব্যাপকভাবে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে ছোট উদ্যোক্তারা কারখানার উৎপাদন সচল রাখতে বিকল্পভাবে ফিলিং স্টেশন থেকে গ্যাস নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো থেকে অবৈধভাবে রিফুয়েলিংয়ের জন্য সরবরাহ করা সিএনজি ভ্রাম্যমাণ বোমায় পরিণত হয়েছে।আগে গভীর রাতে গোপনে ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান ভর্তি গুচ্ছ সিলিন্ডারের মাধ্যমে সিএনজি সরবরাহ করা হতো। এখন দিনরাত ওপেন সিক্রেট এই কার্যক্রম চলছে। এভাবে অবাধে অবৈধ গ্যাস সরবরাহের ফলে চরম ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দ্রুত সময়ের মধ্যে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস রিফিল বন্ধ করা উচিত। কারণ এতে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিষয়টি বিইআরসিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকেও তদারকি বাড়ানো উচিত। যেসব সিএনজি পাম্প বিইআরসির শর্ত ভঙ্গ করে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহ করছে, তাদের লাইসেন্স বাতিল করা উচিত। কারণ তারা সিএনজি পাম্প চালানোর উপযুক্ত নয়।’
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিএনজি ফিলিং স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহ সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ। এ কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বিতরণ কম্পানি, বিস্ফোরক অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহিত করা হবে। একই সঙ্গে যেসব সিএনজি স্টেশন থেকে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে ওই সিএনজি স্টেশনগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা হবে।’
দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ডিভিশন) প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিএনজি পাম্পগুলো থেকে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস নিয়ে শিল্পে সরবরাহ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। আইন অনুযায়ী এটি বিস্ফোরক অধিদপ্তরের দেখার কথা। তিতাস গ্যাসের এটি দেখার কথা নয়।’
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের উপপ্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ফরিদ উদ্দীন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডারে মজুদ ও পরিবহন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কারণ সিলিন্ডারে হাই প্রেসারের গ্যাস থাকে। চট্টগ্রাম, গাজীপুর, সাভার ও নরসিংদী এলাকায় এসব অবৈধ কাজ বেশি হচ্ছে। আমরা বিস্ফোরক পরিদপ্তর থেকে খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেব। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করা হবে।’
গাজীপুর : গত রবিবার সরেজমিনে গাজীপুরের বিভিন্ন সিএনজি স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, দু-তিনটি ছাড়া প্রায় সব সিএনজি স্টেশনে সিলিন্ডারবাহী কাভার্ড ভ্যানে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। যানবাহনের দীর্ঘ লাইন থাকলেও সেগুলোকে দেওয়া হচ্ছে না গ্যাস। আবার অনেক সময় পর দিলেও প্রেসার থাকে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সরকারি সিদ্ধান্তে স্টেশন বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও তা অমান্য করে কারখানাগুলোর কাছে কাভার্ড ভ্যানে বিক্রি করা হচ্ছে গ্যাস।
একই দিন গাজীপুর নগরীর পোড়াবাড়ি এলাকার তালুকদার সিএনজি স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, যানবাহনের দীর্ঘ সারি। কিন্তু যানবাহনে গ্যাস না দিয়ে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে পাশেই রাখা বিশাল কাভার্ড ভ্যানে।
পাশের খান সিএনজি স্টেশনে গিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে। গাড়িচালক মো. মুন্না কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই দুই সিএনজি স্টেশনে চালকদের মারাত্মক হয়রানির শিকার হতে হয়। যানবাহনে বিক্রি না করে সারা দিন গ্যাস বিক্রি করা হয় কারখানার কাভার্ড ভ্যানগুলোতে।
তালুকদার সিএনজি স্টেশনের ম্যানেজার ফরিদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাভার্ড ভ্যানে গ্যাস বিক্রিতে বাধা নেই।’
সদর উপজেলার হোতাপাড়া এলাকার কেআরসি সিএনজি স্টেশনে ভরা হচ্ছিল ভালুকার সীডস্টোর এলাকার এক্সিলেন্ট সিরামিক কারখানার গ্যাস। নাম প্রকাশ না করে ওই কারখানার একজন কর্মকর্তা বলেন, সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত পাইপলাইনে গ্যাস থাকে না। তাই কারখানার উৎপাদন চালু রাখতে বাধ্য হয়ে সিলিন্ডারে গ্যাস নিতে হয়। কাভার্ড ভ্যানটি ছোট হওয়ায় গ্যাস ভরতে সময় লাগে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা।
সাভার : সরেজমিনে সাভারের আশুলিয়ার বাইপাইল, জামগড়া, জিরাবো, পুকুরপারসহ বিভিন্ন এলাকার সিএনজি স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি সিএনজি স্টেশন থেকে প্রকাশ্যে এবং গোপনে রিকশা, ভ্যান ও কাভার্ড ভ্যানে সিলিন্ডারে করে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব সিলিন্ডারে সিএনজি নিয়ে কারখানাগুলোর বয়লার ও জেনারেটরে ব্যবহার করা হয়।
সিলিন্ডারে গ্যাস বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে টিএস সিএনজি রিফুয়েলিং অ্যান্ড কনভারশন লিমিটেড পাম্পের ম্যানেজার আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিটি পাম্পেই এভাবে সিলিন্ডারে করে গ্যাস বিক্রি করা হচ্ছে। যদিও এভাবে গ্যাস বিক্রির সরকারি অনুমোদন নেই। তার পরও স্থানীয় কারখানা মালিকদের অনুরোধে এবং নিজেদের ব্যাবসায়িক স্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডারে গ্যাস বিক্রি করা হচ্ছে।’
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন গাজীপুর ও সাভার প্রতিনিধি]