
সিলেটের তামাবিলের খাসিয়া হাওরে শূন্য রেখায় সার্ভে নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ’র বাড়াবাড়ির কারণে লাঠিসোঁটা নিয়ে বের হয়েছিলেন সীমান্তঘেষা বাংলাদেশ অংশের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যরা নিজ নিজ দেশের সার্ভে টিমকে নিয়ে সরে যান। বৃহস্পতিবার দুপুরে সীমান্তরেখায় এ ঘটনা ঘটে। তবে সার্ভে টিমের এই কার্যক্রম সম্পর্কে বিকেল পর্যন্ত অবগত ছিলেন না সিলেটের জেলা প্রশাসক। স্থানীয় ইউএনও কিংবা ভূমি কর্মকর্তা বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তবে বিজিবি বলছে; ঢাকা থেকে জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দু’দেশের সীমান্ত রেখা নির্ণয় করতে এসেছিলেন। একই সঙ্গে বিএসএফকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের জরিপ কর্মকর্তারাও ওই স্থানে আসেন।
সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরের কয়েকটি এলাকায় শ’শ একর বাংলাদেশের দখলে থাকা ভূমি নিয়ে গত আড়াই দশক ধরে বিরোধ চলছে। বিএসএফ’র পক্ষ থেকে ওই ভূমি তাদের দাবি করায় বার বার উত্তেজনা দেখা দেয়। খাসিয়া হাওর হচ্ছে তামাবিল স্থলবন্দর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। নয়নাভিরাম জায়গা হওয়ার কারণে স্থানীয়রা এ স্থানটিকে সুইজারল্যাণ্ডের প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করেন। প্রায় ৭-৮ একর সমতল ভূমির ওই জায়গায় রয়েছে একটি খেলার মাঠ। সেখানে নানা সময় বড় বড় টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়ে থাকে। খেলতে যান ঢাকা ও সিলেটের খেলোয়াড়রা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন- প্রায় দুই যুগ পূর্ব থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ সদস্যরা বাংলাদেশের দখলে থাকা ৬-৭ একর ভূমি বার বারই দখল করতে উদ্যত হয়েছিলো। ওই সময় বিজিবি’র সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকরা প্রতিবাদ করলে তারা পিছু হটে। গত ১৭ বছর ধরে ওই স্থানে বিএসএফ’র আসেনি। স্থানীয়রা জানান- ১২৭৮-১২৭৯ পিলারের মধ্যে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার মাঠে ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির আলোকে সীমান্ত চিহ্নিতকরণ করে পিলার বসানো হয়েছিলো। ওই পিলারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ে খেলার মাঠসহ আরো কিছু কৃষি জমি। এরপর থেকে বাংলাদেশ অংশের লোকজন এই ভূমি দখলে রেখে ব্যবহার করে আসছিলেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে হঠাৎ করে সেখানে যান বিজিবি’র কর্মকর্তারা। সঙ্গে জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও। ভারতের অংশ থেকে বিএসএফ ও জরিপকারক কর্মকর্তারা আসেন। তারা খেলার মাঠে যাওয়ার পর স্থানীয় কয়েকজন লোক সেখানে কৌতূহল বশত যান। এলাকার লোকজন জানান- সার্ভের শুরুর সময় ভারতের বিএসএফ জওয়ানরা খেলার মাঠকে তাদের ভূমি বলে দাবি করে। এতে আপত্তি জানান উপস্থিত থাকা বাংলাদেশ অংশের সীমান্তবর্তী খাসিয়া হাওর, আমসত্বপুর, নলজুড়ি গ্রামের বাসিন্দারা। এ নিয়ে বিএসএফ’র সঙ্গে তর্ক বাধে তাদের। এ সময় বিএসএফ জওয়ানরা বাড়াবাড়ি করলে স্থানীয় লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে ওই এলাকায় অবস্থান নেন। পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় বিজিবি ও বিএসএফ’র জওয়ানদের পরামর্শে সার্ভে টিমের সদস্যরা ওই এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেই নতুন করে জরিপকাজের আপত্তি জানান খাসিয়া হাওরের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম।
তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন- খেলার মাঠের ওই ভূমি বাংলাদেশের। ভারতের না। জরিপের সময় বিএসএফ জওয়ানরা ভূমি তাদের বলে দাবি করলে উপস্থিত লোকজন ক্ষুব্ধ হন। তারা এ সময় প্রতিবাদ জানান। নতুন করে পিলার স্থাপন না করতে আপত্তি তার। ওই সময় বাংলাদেশের নাগরিকদের সঙ্গে বিজিবি জওয়ানরা ছিলেন বলে জানান তিনি। আব্দুল কাদের নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা জানিয়েছেন- ওই এলাকার ভিটেমাটি আমাদের। বার বার বিএসএফ’র পক্ষ থেকে চোখ রাঙানো হয়। এতে আমরা বিচলিত নই। তবে নতুন জরিপের মাধ্যমে এ ভূমি ভারতের হাতে আমরা তুলে দেবো না। এজন্য জরিপের সময় এলাকার মানুষ ঘটনাস্থলে এসে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তবে তাদের পক্ষ থেকে কেউ কোনো বাড়াবাড়ি করেননি বলে দাবি করেন তিনি। স্থানীয় পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের সদস্য ওমর ফারুক জানিয়েছেন- জরিপের সময় স্থানীয় লোকজন বিক্ষুব্ধ হওয়ার কারণে জরিপ না করে উভয় দেশের কর্মকর্তারা ফিরে গেছেন। তিনি বলেন- জরিপের সময় ভূমি হারানোর আশঙ্কা থেকে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। জরিপকারকরা ফিরে যাওয়ার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
এ ব্যাপারে সিলেটের ৪৮ বিজিবি’র ব্যাটেলিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল নাজমুল হক মানবজমিনকে জানিয়েছেন- বিজিবিকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের জরিপকারকরা ওই স্থানে গিয়েছিলেন। ওপার থেকে ভারতের জরিপকারকরাও এসেছিলেন। স্থানীয় লোকজনের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা দেয়ায় আমরা জরিপকারকদের ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি। তিনি বলেন- ছিট মহল চুক্তির আওতায় ভূমি নিয়ে নতুন করে সার্ভে চলছে। এজন্য সার্ভে টিমের সদস্যরা ওই এলাকায় গিয়েছিলেন। এদিকে- সার্ভের বিষয়টি জানেন না সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। তিনি বিকেলে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ঘটনাটি শুনেছেন। তার দপ্তর থেকে কেউ সেখানে যায়নি। ঢাকার জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গিয়েছিলেন বলে শুনেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন- গোয়াইনঘাটের পাদুয়া ও জৈন্তাপুরের ডিবি’র হাওর নিয়ে তৎকালীন বিডিআর ও বিএসএফ’র মধ্যে গুলি লড়াই হয়েছে। এরপর থেকে পাদুয়া ও ডিবি’র হাওরের অনেক ভূমি জোরপূর্বক দখলে নিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ। প্রায় দেড়যুগ আগে তামাবিলে জোরপূর্বক ঢুকে পড়েছিলো বিএসএফ জওয়ানরা। গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরের পাদুয়া, আলুটিলা, কাঠালবাড়ি, লুনাটিলা, ডিবি’র হাওর কয়েকটি এলাকার শ’শ একর ভূমিই এখন তারা নিজেদের দাবি করছে। তাদের এই দাবির কারণে বাংলাদেশের স্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা জানিয়েছেন-২০১০ সালের ১৪ই মার্চ ভারতের ৪-৫শ বিএসএফ জওয়ান ডিবির হাওরের মন্দিরটিলা ও ২০০৯ সালের ১৭ই জুন প্রতাপপুরের পাদুয়া এলাকার ২০০ একর ভূমি জোরপূর্বক দখলে নেয়।