
জুলাই বিপ্লবের অন্যতম নায়ক শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ও জোবায়ের ওমর খান। তারা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) যথাক্রমে এমবিএ এবং আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
তাদের রক্তের বিনিময়ে দেশবাসী নতুন করে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। কিন্তু এই শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত ক্যাম্পাসে রক্তের দাগ শুকানোর আগেই নিয়োগ পেয়েছেন গণহত্যার সঙ্গে জড়িত দুই দোসর। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে।
বিইউপিতে শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ ক্যাডার মৌমিতা রহমান ঈস্পিতা ও আওয়ামীপন্থি হিসেবে ধিকৃত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া। তাদের মধ্যে মৌমিতাকে সম্প্রতি বিইউপির আইন বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সহসভাপতি। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাইদের মধ্য থেকে যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী পরিবারের এ ক্যাডারকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিজজেন স্টাডিজ ফ্যাকাল্টির স্ট্রাটেজিক ম্যানেজমেন্ট বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত উপাচার্য অধ্যাপক বদরুজ্জামান। আওয়ামী লীগের দোসর হওয়ার অভিযোগে ৫ আগস্ট-পরবর্তী শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পদত্যাগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এই শিক্ষক।
এভাবে একের পর এক গণহত্যার দোসরদের পুনর্বাসনের ঘটনায় চরম ক্ষোভ ও অস্থিরতা দেখা দেয় শিক্ষার্থীদের মাঝে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এ ধরনের নিয়োগের মাধ্যমে শহীদদের প্রতি অসম্মান জানানো হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কার এবং সেশন ফি কমানোসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীর। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধেও বিইউপি কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থান নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে আন্দোলনে জড়িত দুই শিক্ষার্থীকে এক বছর সাসপেন্ড (সাময়িক বহিষ্কার) ও ছয়জনের নামে থানায় জিডিসহ আর্থিক জরিমানা করার তথ্য পাওয়া গেছে।
জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিইউপিতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের পুনর্বাসনের ঘটনা ঘটে থাকলে তা খুব দুঃখ ও হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ। তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের নায়করা আমাদের নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা যেভাবে জীবন দিলেন, আহত হলেনÑ তাদের সে অবদানকে অবজ্ঞা করা দুঃখজনক। আমাদের সবাইকে সচেতনভাবে কাজ করা উচিত।’
শহীদ মুগ্ধ ও জোবায়েরের কয়েক সহপাঠী অভিযোগ করে বলেন, গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর সব বিশ্ববিদ্যালয় স্বৈরাচারমুক্ত হলেও বিইউপি রয়ে গেছে আগের মতোই। গত ১ ও ২ সেপ্টেম্বর বিইউপির সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত ও সংস্কারের ন্যায্য দাবি তুললে জ্যেষ্ঠ এক কর্মকতা বিইউপি শিক্ষার্থীদের তাচ্ছিল্য করে খেপিয়ে তোলেন। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে সড়কে গিয়ে গেট বন্ধ করেন। পরে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও তা না করে উল্টো কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় ‘মিথ্যা মামলা’ ও দুজনকে সাময়িক বহিষ্কার করে। শুধু তাই নয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখে, যাতে অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে না পারেন।
শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, অধ্যাপক বদরুজ্জামান গণহত্যার সরাসরি দোসর হলেও তিনি বিইউপিতে পাঠদান করেন। গত ২০ এপ্রিল রাতে আওয়ামী দোসর শিক্ষকরা বিপ্লবকে নস্যাৎ, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য জুম মিটিং করেন। ওই মিটিংয়ে নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক বদরুজ্জামান। বিইউপি থেকে রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন কাজেও লিপ্ত তিনি।
তারা আরো বলেন, এর আগে জুলাই বিপ্লবের সময় ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষ নিয়ে এবং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দমনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের একটি গোপন অনলাইন সভার ভিডিও ফাঁস হয়। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, তৎকালীন ভিসি বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় শিক্ষক অংশ নেন। এসব বিষয় জানাজানি হওয়ার পর তাকে বিইউপি থেকে বাদ দেওয়া হয়। এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে না পারলে বিইউপি থেকেই প্রতিবিপ্লবের ডাক আসতে পারে।
বিইউপিতে খণ্ডকালীন চাকরির বিষয়টি স্বীকার করে বদরুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, ‘সেখানে এখন আর আমি নেই। তাদের কোর্স শেষ হয়ে গেছে, আমাকে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে এখন পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত হচ্ছি।’
তবে এসব অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিইউপিতে কখনই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ হয় না, মেধার ভিত্তিতে হয়। বদরুজ্জামানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তা আগে তাদের জানা ছিল না। বিষয়টি জানার পর এরই মধ্যে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর মৌমিতার দলীয় পরিচয়ও কারোরই জানা ছিল না। এ বিষয়ে অভিযোগ ওঠার পর বিষয়টি তদন্তে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তার পাঠদান বন্ধ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াধীন।
কয়েক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার ও জিডি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিইউপি ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে অবস্থিত। আইন ভঙ্গ করে গেটের বাইরে গিয়ে আন্দোলন করায় ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষ ১১ জনের নামে জিডি করেছে। এ কারণেই দুজনকে এক বছরের জন্য সাসপেন্ড এবং ছয়জনকে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এক শিক্ষার্থী ও মিরপুর ডিওএইচএসে বসবাসকারী এক অভিভাবক বলেন, উত্তাল জুলাইয়ের ১৮ তারিখ মিরপুর-১২ নম্বরে আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ তাদের ধাওয়া করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলে তখন গেট খোলা হয়নি। ওই সময় ডিওএইচএসে যাওয়ার সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগ যৌথভাবে সশস্ত্র হামলা চালালে গুলিবিদ্ধসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। ওই ঘটনায় জড়িতদেরও বিচার হতে হবে।