
গবেষণায় সুফল মিললেও রহস্যজনকভাবে নীতিনির্ধারক আমলাদের অনীহার কারণে দেশে চাষ হচ্ছে না সম্ভাবনাময় সুগারবিট। গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুগারবিট চাষে উৎপাদিত চিনি দিয়ে দেশের ৩০ লাখ টন চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি এবং দামও অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তারা।
জানা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে সুগারবিট চাষ প্রযুক্তি উন্নয়নে ‘বাংলাদেশে ট্রপিক্যাল সুগারবিট উৎপাদন ও বিস্তার কর্মসূচি’ শিরোনামে একটি পাইলট প্রকল্প নেয় সরকার। ৬৯০ কোটি টাকার তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের আওতায় বেশ ক’টি চিনিকলের জমিতে চাষ করা হয় এ ফসল। গবেষণায় এর সুফলও মেলে। তবে প্রায় দেড় দশকেও এর সম্প্রসারণে কোনো উদ্যোগ নেয়নি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)।
বরং সুগারবিট গবেষণা ও উৎপাদনের নামে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সপরিবারে বিদেশ ভ্রমণ, সেমিনার-সিম্পুজিয়াম ও মাঠ পরিদর্শনসহ নানা কর্মসূচির নামে ৬৯০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। কার্যত এই অর্থ লুটপাট হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ জন্য আমলাদের অনাগ্রহকেই দায়ী করা হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চিনিকলগুলোয় সুগারবিট থেকে চিনি উৎপাদনের যন্ত্র না থাকায় এটি আর এগোয়নি। চিনিকলে যেসব মেশিন রয়েছে তা দিয়ে সুগারবিট থেকে চিনি উৎপাদন সম্ভব নয় বলে অনাগ্রহ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএসআরআই) কৃষিতত্ত্ব ও ফার্মিং সিস্টেম বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. একেএম রাশেদুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, ২০০৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত গবেষণায় আশাবাদী হওয়ার মতো উপাত্ত পাওয়া গেছে। বিশ্বে আখ থেকে চিনি সংগ্রহের হার ১০ শতাংশ হলেও সুগারবিটে ১৪ শতাংশের বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে উৎপাদিত সুগারবিটে ১৫ শতাংশ চিনি রয়েছে। সুগারবিট চাষে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বিষয়টি কেন এগোয়নি তা নীতিনির্ধারকরা বলতে পারবেন।
গবেষণার নামে ৬৯০ কোটি টাকা লুটপাটের বিষয়ে জানতে বিএসআরআই মহাপরিচালক ড. কবির উদ্দিন আহমেদকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, মিটিংয়ে আছি, একটু পরে ফোন করেন। এরপর থেকে ফোনটি ব্যস্ত পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের যুগ্ম সচিব এবং পরিচালক (ইক্ষু উন্নয়ন ও গবেষণা) ড. আব্দুল আলীম খান বলেন, তিন মাস আগে এ পদে এসেছি এ বিষয়ে আমার কোনো কিছু জানা নেই। আপনি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্রের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া না পেয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে সুগারবিট চাষ করে আসছেন অর্গানিক বাংলাদেশ লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস ছালাম। তিনি কারখানা প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে সুগারবিট উৎপাদন করছি। চিনিকল নির্মাণে অনেক ব্যাংকে যোগাযোগ করেছি, কিন্তু সাড়া পাইনি। তাই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি।
আগামী বছরের মার্চ থেকে উৎপাদন শুরু করব। শুরুতে ২১ হাজার টন চিনি উৎপাদন করতে পারব বলে আশা করছি।’ তিনি আরো বলেন, দেশের ৩০ লাখ টন চাহিদা মিটাতে অনুরূপ ২০০টি মতো কারখানা লাগবে। এতে উৎপাদন খরচ কম বলে প্রতি কেজি চিনি ৭০ টাকায় বিক্রি সম্ভব। তিনি বলেন, সুগারবিট বহুমুখীভাবে ব্যবহার করা যাবে। বিভিন্ন দেশে সুগারবিট থেকে চিনি উৎপাদিত হয়। এটা স্বল্পমেয়াদি ফসল, ফলন ও চিনি আহরণের হার বেশি। ফলে আখের চেয়ে বেশি চিনি উৎপাদন সম্ভব।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আখ থেকে চিনি উৎপাদন করতে গিয়ে সংকটে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো। কাঁচামাল সংকটে ও নানা অব্যবস্থাপনায় দেশের ১৫টি চিনি কলের মধ্যে দীর্ঘদিন লোকসানে থাকা ছয়টির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে ৯টি চিনিকল উৎপাদনে রয়েছে সেগুলোও কাঁচামাল সংকটে মাড়াই মৌসুম শেষ হওয়ার অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক দেশ প্রায় ১০০ বছর আগে আখ চাষ বন্ধ করে সুগার বিট চাষ শুরু করেছে। এর কারণ, আখ ১৪ মাসের ফসল এবং ১০০ কেজি আখ থেকে চিনি হয় মাত্র পাঁচ কেজি। আখের ছোবড়া জ্বালানি হিসেবেই ব্যবহার হয়। অন্যদিকে, সুগারবিট মাত্র পাঁচ মাসের ফসল এবং ১০০ কেজি সুগারবিট থেকে চিনি পাওয়া যায় ১৬-২০ কেজি। সুগারবিট থেকে চিনি ও পশুখাদ্য উৎপাদন হয়, এর পাতা-ডগা থেকে গ্যাস এবং সার উৎপাদন হয়। ফলে সুগারবিট চাষ আখের চেয়ে লাভজনক হলেও রহস্যজনক কারণে তা চা করা হচ্ছে না।
বিএসএফআইসি সর্বশেষ লাভের মুখ দেখেছিল ২০০৫-০৬ অর্থবছরে। ওই বছরে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা লাভ করেছিল। এরপর গত দেড় যুগে মোট ৯ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। বিএসএফআইসি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে চলছে, সেভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে লাভের মুখ দেখার কোনো সম্ভাবনা নেই।
কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, এভাবে লোকসানি প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কেউ কেউ মনে করেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমাধান নয়, লোকসান দেওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।