
সচ্ছল পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। করতেন রাজধানীর উত্তরায় ফুটপাতে পোশাকের ব্যবসা। নিজের উপার্জনের টাকায় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু এক গুলিতেই তার সে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। বলছিলাম শহীদ জাকারিয়া হাসান জুয়েলের কথা, যিনি জুলাই আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহীদ হন। ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান তিনি।
জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি সফল করতে উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের ভাড়া বাসা থেকে সকালেই বেরিয়ে যান জাকারিয়া। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার জন্য কিছু পানির বোতল কিনে নিয়ে যান তিনি। দুপুর ২টায় মুঠোফোনে স্ত্রী (একটি বেসারকারি মেডিকেলের নার্স) পাপিয়া শর্মীকে বলেছিলেন, ‘চিন্তা কইরো না, বেশিক্ষণ থাকব না। সব ঠিকঠাক আছে। একটু পরেই বাসায় ফিরে যাব।’ এরই মধ্যে শর্মীর কর্মস্থলের এক সহকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন। তখনই তিনি চিন্তায় পড়ে যান আন্দোলনরত জাকারিয়াকে নিয়ে। জাকারিয়াকে কল করেন তিনি। কল রিসিভ করতেই শর্মীর কানে আসে গুলির শব্দ। জাকারিয়াকে শাসনের স্বরে বলেন বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু জাকারিয়া ‘আরেকটু পরই চলে যাব। চিন্তা কইরো না’ বলে মোবাইল রেখে দেন।
এদিকে শর্মী কল করা অব্যাহত রাখেন। বিকাল ৫টার দিকে জাকারিয়া কল রিসিভ করতেই কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে পাপিয়া শর্মী বলেছিলেন-
‘দেখো গত মাসেই মাত্র আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হলো। অনেক কষ্টের সংসার আমাদের। অনেক লড়াইয়ের পর আমরা এক হলাম। আমাকে তুমি এখনই বিধবা বানাইও না। বাসায় ফিরে যাও, নতুবা আমি আসতেছি।’ উত্তরে জাকারিয়া বলেছিলেন-‘এই তো বাসায় ফিরে যাব। খারাপ চিন্তা কইরো না। কিছু হবে না ইনশাল্লাহ।’
সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আন্দোলনে থেকেই স্ত্রীর ফোন কাটার কয়েক মিনিটের মধ্যেই পেটে গুলিবিদ্ধ হন জাকারিয়া। হাসপাতালের দিকে নিয়ে যান কয়েকজন সহযোদ্ধা। বিষয়টি জাকারিয়ার ফোনে থাকা নম্বর থেকেই এক নিকটাত্মীয়কে কল করে জানান সহযোদ্ধারা। ওই আত্মীয় স্ত্রী শর্মীর মুঠোফোনে কল করে জাকারিয়ার গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি জানান। ওই আত্মীয় জানান, তাকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। শর্মীকে দ্রুত সেখানে যাওয়ার জন্য বলেন। শর্মী সেখানে গিয়ে জানতে পারেন আইসিইউতে রাখা হয়েছে গুলিবিদ্ধ জাকারিয়াকে। সেখানে ঢুকতেই দেখেন জাকারিয়া চোখ বন্ধ করে আছে। তিনি গুলি বের করার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছিলেন চিকিৎসকদের। কিন্তু এরই মাঝে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে শহীদি মিছিলে যুক্ত হন জাকারিয়া।
জাকারিয়ার গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা শুনেই কোনো গাড়ি না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বাবা আকবর আলী শেখ, মা ঝর্ণা বেগম ও বড় ভাই জহিরুল ইসলাম গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকা আসেন। কিন্তু তারা আসার আগেই জাকারিয়া না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। এরপর উত্তরা থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে শহীদ জাকারিয়ার লাশ নেওয়া হয় গ্রামের বাড়িতে। পরদিন ১৯ জুলাই জানাজার পর গাজীপুরের কালীগঞ্জের দেওপাড়ার পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
শহীদ জাকারিয়ার স্ত্রী শর্মী বলেন, সচ্ছল পরিবারের সন্তান হয়েও জাকারিয়া ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। নিজের উপার্জনের টাকায় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখা জাকারিয়া উত্তরায় ফুটপাতে পোশাকের ব্যবসা করতেন। ১০ বছরের পরিচয়ে দেখেছি, সব সময় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন।
শহীদ জাকারিয়া হত্যার সুষ্ঠু বিচার এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়ে স্ত্রী বলেন, সব শহীদের সহধর্মিণী ও সন্তানদের নিরাপদ জীবন এবং অধিকার নিশ্চিত করা হোক, যাতে তারা শহীদের স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে পারেন।