Image description

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে ২০২১ সালে ‘বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রাম’ নামে একটি প্রকল্প নেয় সমবায় অধিদপ্তর। মূলত শেখ হাসিনাকে খুশি করতে তার বাবার নামে নেওয়া প্রকল্পটি চার বছর পেরিয়ে গেলেও কাজ হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ। এরই মধ্যে অর্থ ছাড় হয়ে গেছে ৮০ শতাংশ।

দেশের সাতটি বিভাগের ৯টি জেলার ১০টি উপজেলা মানবসম্পদ, কৃষিজ সম্পদ ও পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে ১০টি মডেল গ্রাম নির্মাণের লক্ষ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করে সমবায় অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি, ৭ শতাংশ দারিদ্র্য কমানো, কৃষি খাতে ২০ শতাংশ আয় বৃদ্ধি, ৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থানসহ সামজিক পুনর্জাগরণের কথা বলা হয়। বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও হয়নি। পরে নানা সমালোচনার মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে ‘সমবায় মডেল গ্রাম প্রতিষ্ঠা পাইলট’ প্রকল্প নামকরণ করে পরিকল্পনা কমিশন।

জানা গেছে, ১০টি উপজেলায় একটি করে কমিউনিটি ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য কাজের জন্য ৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাঁচ বছর হতে চলল, এখন পর্যন্ত কিছু উপজেলায় ভবন নির্মাণের জমিই অধিগ্রহণ করা হয়নি। কাজ বাস্তবায়নের নামে প্রতিটি উপজেলা কমিটিতে এমপি-মন্ত্রীদের স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের যুক্ত করে ভবন নির্মাণ ও প্রশিক্ষণের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। প্রায় ২৭০টি প্রশিক্ষণের নামে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র প্রশিক্ষণের আয়োজন করে কমিটির সঙ্গে মিলেমিশে পুরো টাকাই লোপাট করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কৃষক ও মৎস্য খামারিদের প্রশিক্ষণের কথা বলে একেকটা প্রশিক্ষণে ৩০ থেকে ৬০ জন সুবিধাভোগীর নাম তালিকাভুক্ত করা হয়, যাদের বেশিরভাগই ভুয়া।

উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সবকিছুতে বাড়তি দাম ধরা হয়েছে। ডিপিপি ঘেঁটে দেখা গেছে, এক টনের একটি পিকআপের ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া সোলার প্যানেল ৫০ লাখ টাকা, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট ১০ লাখ, কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ ৬০ লাখ, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ২০ লাখ, ডকুমেন্টারি ৮ লাখ, ভ্রমণ ব্যয় ৩ লাখ, সেমিনার ১২ লাখ, অধিদপ্তরের গাড়ি ব্যবহার করা হলেও গাড়ি ভাড়া বাবদ ৪০ লাখ, জ্বালানি খরচ ১৭ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এর বাইরে বাড়িভাড়া ১০ লাখ ৬৬ হাজার, চিকিৎসা ভাতা ২ লাখ ১৬ হাজার, উৎসব-বিনোদন, নববর্ষসহ বিভিন্ন ভাতা ১৮ লাখ ৩ হাজার টাকা বরাদ্দ নিয়ে তার পুরোটাই আত্মসাৎ করেছেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি)। এ ছাড়া মৎস্য খামার প্রদর্শনীর জন্য ৯০ লাখ টাকা, পরামর্শক ব্যয় ২৪ লাখ, সেচ অবকাঠামো ২ কোটি ৬০ লাখ, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ ৬০ লাখ, কৃষি যন্ত্রে ভর্তুকির জন্য ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও বাস্তবে কোনো টাকাই এ প্রকল্প থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়নি।

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ঢাকা প্রকল্প দপ্তর প্রশিক্ষণ, সরবরাহ, সেবা ক্রয় ও সংগ্রহের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া কৃষি যন্ত্রপাতি ভর্তুকি, প্রদর্শনী খামার আবর্তক তহবিল কমিউনিটি ভবন নির্মাণে ব্যয় ৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। একইভাবে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি, জামালপুরের মাদারগঞ্জ, কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ, যশোরের মনিরামপুর, রংপুরের মিঠাপুকুর, সুনামগঞ্জের দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, বরিশালের মুলাদী ও গৌরনদী উপজেলা এবং সংশ্লিষ্ট পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এলাকায় একটি করে কৃষি যন্ত্রপাতি ভর্তুকি, প্রদর্শনী খামার আবর্তক তহবিল কমিউনিটি ভবন নির্মাণে প্রতিটির ব্যয় ৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এসব জেলার কিছু উপজেলায় এখনো ভবনের কাজ শুরু করতে পারেনি সমবায় অধিদপ্তর। কিন্তু অর্থ ঠিকই ব্যয় হয়ে গেছে।

প্রশিক্ষণ: প্রকল্পে ২৭০টি প্রশিক্ষণ কোর্স রাখা হয়েছে। কৃষি ও মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, যুব ও মহিলাবিষয়ক এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরে সহায়তায় ট্রেডভিত্তিক তিন দিনের প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পাদন করার কথা। অংশগ্রহণকারী ৪০ জন। প্রতিটি কোর্সে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা হিসাবে ১২৫টি কোর্সের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর পাঁচ দিনের কোর্সে অংশগ্রহণকারী ৩০ জন। একটি কোর্সের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। এ হিসাবে ১০টি কোর্সের জন্য ব্যয় ২৫ লাখ টাকা। তিন দিনের আরেকটি কোর্সে অংশগ্রহণকারী ৩০ জন। একটির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার। ১০টি কোর্সে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ লাখ টাকা। এ তিন ধরনের ২৭০টি কোর্সের জন্য ব্যয় ৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এসব কোর্সের নামে দিয়ে স্থানীয় কমিটির সদস্যের সঙ্গে মিলেমিশে পুরো টাকায় প্রশিক্ষণের নামে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ছাড়া অধিদপ্তরে দুটি সেমিনারের জন্য ৪ লাখ এবং এক দিনের একটি কোর্সে জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা।

জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা হয়েও প্রকল্পে বাস্তবায়নে আলাদা করে বেতন নিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। সমবায় অধিদপ্তরের পঞ্চম গ্রেডের এই কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে মাসে ৪৩ হাজার টাকা বেতন নিয়েছেন।

প্রকল্পের ডিপিপিতে দেখা গেছে, ‘বঙ্গবন্ধু গণমুখী সমবায় ভাবনার আলোকে বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রাম প্রতিষ্ঠা পাইলট’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদনের পর ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে সমবায় অধিদপ্তর। এরপর সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। তার পরও প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া কিছু উপজেলায় এখনো ভবন নির্মাণের জমি অধিগ্রহণ করতে পারেনি। একইভাবে সমবায় অধিদপ্তর ‘আমার শহর আমার গ্রাম’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পে গ্রামের বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রেখে গ্রামীণ সম্পদের সুষ্ঠু ও সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করা, গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষির আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণ এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ ও বাজার অবকাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলা হলেও তার সুফল আসেনি।

জানতে চাইলে সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. শরিফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মডেল গ্রাম’ প্রকল্প চলমান। গত বছর কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলে নতুন করে সময় বাড়ানো হয়েছে। কাজের অগ্রগতি বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৪০ শতাংশের মতো কাজ শেষ হয়েছে মনে হয়। এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন প্রকল্প পরিচালক।