Image description

আমদানিতে লাগাম টানার চড়া মূল্য দিচ্ছে দেশের শিল্প খাত। রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আমদানিতে লাগাম টেনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা দীর্ঘ সময় অব্যাহত ছিল। এতে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে। এর অর্থ হলো বিনিয়োগ কম হচ্ছে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি কমিয়ে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অর্থনীতির জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। ডলার সংকটে কাঁচামাল আনতে না পেরে, চড়া মূল্য দিয়েও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি না পেয়ে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো কারখানা সক্ষমতার অর্ধেক কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফলে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় খেলাপিতে পরিণত হয়ে পড়ছেন ভালো ঋণগ্রহীতারাও। এমন পরিস্থিতিতে গভীর সংকটের মুখে পড়েছে বেসরকারি খাত।

দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসব নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতায় সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের জন্যই উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ কালের কণ্ঠকে বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমার কারণ চলমান অনিশ্চয়তা। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়নি, কারখানায় জ্বালানি নিরাপত্তা নেই, ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৬ শতাংশ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা স্বস্তি বোধ করছেন না। এমন পরিবেশে বিনিয়োগ হওয়ার কোনো কারণই নেই।  অনিশ্চয়তার মধ্যে কেউ বিনিয়োগ করবেন না। বিদ্যমান ব্যবসা কিভাবে ধরে রাখতে পারবেন, তা নিয়ে গভীর সংকটে আছেন উদ্যোক্তারা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি এবং বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া আমাদের বেসরকারি খাতভিত্তিক অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। বিনিয়োগকারীরা তাঁদের বর্তমান ব্যবসার সম্প্রসারণ এবং নতুন ব্যবসার উদ্যোগ পিছিয়ে দিয়েছেন। এর মূল কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং ক্রয়ক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটেছে। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত আমদানিতে বেশ কড়াকড়ি ছিল। তার তুলনায় সামগ্রিক আমদানি পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি পূর্ববর্তী অবস্থায় এখনো ফেরত যায়নি। আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী ঘটনাপরিক্রমায় বিনিয়োগকারীরা এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এখন উদ্যোক্তারা গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর কবে কিভাবে হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন। সেই নিশ্চয়তা ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ আসবে না।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বিনিয়োগ যখন কমে যায়, তার প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানে। শিল্প উৎপাদন কমে গিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে দেশে সামগ্রিকভাবে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৯৪.১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। তবে অর্থবছর বিবেচনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মোট চার হাজার ৬৪৫.৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, আগের অর্থবছরে যা ছিল চার হাজার ৪১০.৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ অর্থবছর বিবেচনায় আমদানি বেড়েছে ৫.৩৩ শতাংশ।

মূলধনী যন্ত্র আমদানি কমেছে ২৬.০২ শতাংশ : ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানির তথ্য প্রকাশ করলেও মার্চ পর্যন্ত এলসি খোলার হিসাব দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ঈদের বাড়তি চাহিদার কারণে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার হার বাড়লেও ক্যাপিটাল মেশিনারি বা মূলধনী যন্ত্র আমদানির জন্য খোলা এলসির হার কমেছে ২৬.০২ শতাংশ এবং এলসি নিষ্পত্তির হার কমেছে ২৮.৬৮ শতাংশ। মধ্যবর্তী পণ্য বা ইন্টারমিডিয়েট গুডসের এলসি কমেছে ১.৬১ শতাংশ, নিষ্পত্তি কমেছে ৭.৫১ শতাংশ এবং পেট্রোলিয়ামের এলসি কমেছে ৩.৮৩ শতাংশ।

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ২১ বছরে সর্বনিম্ন : ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৬.৮২ শতাংশ হয়েছে, যা ছিল ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির পরে আর কখনো এতটা কম হয়নি বেসরকারি খাতে ঋণ।

মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমলে বিনিয়োগ আরো কমবে, যার চূড়ান্ত প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানের ওপর। এতে সামষ্টিক অর্থনীতি আরো শ্লথ হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। সংকট উত্তরণে সবার আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি বলেও মনে করেন তাঁরা।

কর্মসংস্থানের গতি কমেছে : এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার বেড়েছে এক লাখ ৭০ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শ্রমশক্তি জরিপে এই তথ্য উঠে এসছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে ২৬ লাখ ৬০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সালের এই সময়ে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। গত সেপ্টেম্বর মাস শেষে দেশে পুরুষ বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৯০ হাজার, আর নারী বেকার আট লাখ ৭০ হাজার।

বিবিএস বলছে, শ্রমশক্তিতে এখন পাঁচ কোটি ৯১ লাখ ৮০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। অথচ ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে এই সংখ্যা ছিল ছয় কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা কমেছে ১৯ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচ কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত; বাকিরা বেকার।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.২২ শতাংশে নেমেছে : দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.২২ শতাংশে নেমেছে। আগের সরকারের সাময়িক হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫.৮২ শতাংশে নামবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই ধারণার চেয়েও কমেছে প্রবৃদ্ধির হার। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাবে এই তথ্য উঠে এসেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির এমন পতনের পেছনে দেশের ব্যাংক খাতে লুটপাট, অব্যাহত অর্থপাচার, রপ্তানি আয়ের সংশোধিত হিসাবসহ বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা হয়।

রাজস্ব ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা : ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় তা কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। সেই হিসাবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বছরে ৩৬৫ দিনের প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ২৭০ কোটি টাকা আদায় করতে হতো। তবে প্রথম ৯ মাসের আদায়ের বিরাট রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেওয়ায় তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে, যা আদায়ের কাছাকাছি যাওয়াকেও খুবই চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি জাবেদ আখতার বলেন, ব্যবসা বাড়লে রাজস্ব আদায় এমনিতেই বাড়বে। ব্যবসার জন্য কঠিন পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে। কাস্টমস সেবার সহজীকরণ, প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ কিভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার।

ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়ায় মানুষের আয়ে প্রভাব পড়েছে। একই সঙ্গে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি কমে গেছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প কমে যাওয়া এর কারণ। তবে সরকার ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনার চেষ্টা করছে। মানুষের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। সে জন্য নতুন কর্মসংস্থান দরকার।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ব্যবসার খরচ কমলে বিনিয়োগও বাড়বে। বিনিয়োগ করলে রিটার্ন আসবেএই নিশ্চয়তা ব্যবসায়ীদের দিতে হবে। ধীরে ধীরে ব্যাংকিং, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসবকিছুরই উন্নতি হচ্ছে। ব্যাবসায়িক পরিবেশ যে সামনে আরো ভালো হবে সে বিষয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে।