Image description

সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে 'বিব্রতকর' প্রশ্ন করা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নয় মাসে অন্তত ২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যা চেষ্টাসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রসঙ্গ গতকাল শনি (৩রা মে) ও আজ রোববারের (৪ঠা মে) কয়েকটি আলোচনা অনুষ্ঠানে ঘুরেফিরে এসেছে। অনুষ্ঠানগুলোতে দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, সম্পাদক ও গণমাধ্যমের মালিকদের বক্তব্যে বিষয়গুলো উঠে আসে। একই বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও পাওয়া গেছে। এর জের ধরে আগে থেকেই বিভক্ত সাংবাদিক সমাজে নানা আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা চলছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়গুলো নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক।

উপদেষ্টাকে তিনজন সাংবাদিকের করা প্রশ্ন এবং জাতীয় ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের ৩রা মে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ‘একই সূত্রে গাঁথা’ বলে মন্তব্য করেছেন দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী রোববার ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যে বক্তব্যে দেন, এতে মাহমুদুর রহমানের মন্তব্যের জবাব পাওয়া গেছে বলে মনে করছেন অনেক সাংবাদিক।

গত ২৯শে এপ্রিল সংস্কৃতি উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে ‘জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে অবমাননাকর’ প্রশ্ন করার অভিযোগে ঢাকার বেসরকারি তিনটি টিভি চ্যানেলের (দীপ্ত, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই) তিন সাংবাদিককে কর্তৃপক্ষের চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ উঠে। কলামিস্ট ও দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান মনে করেন, সংবাদ সম্মেলনে করা ‘তিন সাংবাদিকের প্রশ্নের মান ও ঔচিত্য নিয়ে সংশয় আছে’। তিনি বলেন, গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে ‘শহীদদের বিষয়ে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের আরও সতর্ক ও সংবেদনশীল থাকা উচিত ছিল’। তবে ‘অনুচিত প্রশ্ন করার কারণে সাংবাদিকের চাকরি যাওয়ার উদাহরণ সম্ভবত এটাই প্রথম।’

আওয়ামী লীগের সরকারের রোষানলে পড়া ও বারবার নির্যাতনের শিকার হওয়া মাহমুদুর রহমান মনে করেন, উপদেষ্টাকে তিনজন সাংবাদিকের করা প্রশ্ন এবং ডেইলি স্টারের ৩রা মে প্রকাশিত প্রধান প্রতিবেদন একই সূত্রে গাঁথা।' তার মতে, ‘তিনজন সাংবাদিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্ন করেছিলেন এবং আজকে (গতকাল) একটা ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার যে হেডলাইন (শিরোনাম), এটা কিন্তু এক সূত্রে গাঁথা। এটার উদ্দেশ্যটাই হচ্ছে যে, বাংলাদেশে আবার ফ্যাসিবাদ ফিরিয়ে আনার একটা প্রেক্ষাপট রচনা করা। আবার ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ ফিরিয়ে আনার একটা প্রেক্ষাপট রচনা করা।’

তিনজন সাংবাদিকের করা প্রশ্ন এবং সেই ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদনের মাধ্যমে তৈরি করা ন্যারেটিভ (বয়ান) বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, '২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিদিন ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছিল এবং তার ফল ছিল এক–এগারো।' বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের আয়োজিত সেমিনারে মাহমুদুর রহমান এসব কথা বলেন। শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী ডেইলি স্টারের ওই প্রতিবেদনের সমালোচনা করেন। ২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার বিষয়ে করা ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে তিনি বলেন, 'সংবাদটির মাধ্যমে পত্রিকাটি বলতে চেয়েছে আগের আমলের (আওয়ামী লীগ) মতো এখনো সাংবাদিকরা নির্যাতিত হচ্ছেন। কিন্তু আগের সময় ও বর্তমান সময়ের মধ্যে যে গুণগত পার্থক্য হয়েছে, সে কথা বলা হয়নি।' বিষয়টি 'দুর্ভাগ্যের' বলে উল্লেখ করেন তিনি।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ২৬শে জুলাই ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তাকে  আন্দোলন আরও কঠোর হাতে দমনে উৎসাহ দেন। অনেকে মনে করেন, তারা সাংবাদিক হিসেবে নন, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সেদিন কাজ করেছিলেন। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের অনুসারীরা যখন ছাত্রদের উপর গুলি চালাচ্ছিলেন জুলাই-আগস্টে, তখন একটি ভিডিওতে দেখা যায় যে, স্থানীয় দু'জন সাংবাদিক শামীম ওসমানের সঙ্গে একটি মিছিলে ছিলেন। একজন সাংবাদিককে দুই হাতে দু'টি আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতেও দেখা গেছে ওই ভিডিওতে। বিভিন্ন জেলার এমন সাংবাদিক, যারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ছিলেন, তারাও আছেন মামলা দায়ের হওয়া ২৬৬ জনের তালিকায়।

অন্যদিকে জাতীয় প্রেসক্লাবে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রোববার আয়োজিত সম্পাদক পরিষদের আলোচনা সভায় ‘এমন দেশে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি, যেখানে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়’ বলে আক্ষেপ করেন মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, 'অবাক লাগে, আমি বিস্মিত হই, জানি না, আমি কাকে দায়ী করব? আমি কি সরকারকে দায়ী করব, না, আমি কি মালিককে দায়ী করব, না করব না, সাংবাদিক ইউনিয়ন কী করছে বা আমাদের সম্পাদক পরিষদ, যেটিতে আমি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এখন পর্যন্ত আছি, আমি মনে করি আমরাও ব্যর্থ হয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘যা–ই হোক আত্মসমালোচনা আমাদের দরকার, আমরা আসলে কতটুকু করতে পেরেছি। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে অনেকখানি। এক বছর আগে যে অবস্থা ছিল, সেই অবস্থা এখন আর নেই। অনেকখানি বদলেছে।’ গণমাধ্যমে অনৈক্য ও বিভাজন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে উল্লেখ করে মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘আমি আশা করব, পত্রিকায় পত্রিকায়, ইদানীং আবার টেলিভিশনে টেলিভিশনের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, এটি অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত।’

দেশে বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা–সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহ্ফুজ আনাম একই অনুষ্ঠানে বলেন, 'গণহারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের আক্রমণ (মামলা) স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী এবং এটি ভয়ের ব্যাপার। শেখ হাসিনার শাসনামল এতো জনধিক্কৃত হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং আরও অনেক আইনের শিকার হয়েছিলাম। তবে বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা–সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলা চলছে।'

মাহফুজ আনাম বলেন, 'এটা কীভাবে সম্ভব? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ২০০ বা কিছু বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। ২৬৬ জন সাংবাদিক আজকে খুনের মামলা অথবা সহিংসতা–সংক্রান্ত অপরাধের মামলার আসামি। এটা আমাদের জন্য অসম্মানের।’

রোববার ঢাকার ধানমন্ডিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দৈনিক সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের মালিক একে আজাদ বলেন, 'সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হচ্ছে। সাংবাদিকরা তো হত্যা করতে যাননি। হ্যাঁ, অনেকে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে সহিংসতায় উসকানি দিয়েছেন। এ কারণে সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার মামলা করা যায়। আইনে সেই বিধান আছে, কিন্তু হত্যা মামলা দিয়ে আটক রাখা হয়, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলেই এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ, বৈরী পরিবেশ বলে মনে হয়।'

সম্পাদক পরিষদের অনুষ্ঠানে নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, ‘বাংলাদেশে আজকের দিনে যখন মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছেন, ঠিক তার এক বছর আগেও সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে দিবসটি পালন করেছিলেন। কিন্তু এই দুই দিবসের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য সূচিত হয়েছে। কিংবা পার্থক্য সূচিত হওয়ার লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছে।’

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠের সম্পাদক হাসান হাফিজ একই অনুষ্ঠানে বলেন, দীর্ঘ ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে অনেক গণমাধ্যম বন্ধ হয়েছে, তারাও অনেক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, সেগুলো আর ভবিষ্যতে চাইবেন না। জনগণের সমর্থন নিয়ে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, তারা মুক্ত গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ৩রা মে ডেইলি স্টার ‘২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ’ শিরোনামে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, দেশে সাংবাদিকদের হামলা-মামলা করে হয়রানির যে পুরোনো সংস্কৃতি ছিল তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত ৫ই আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন রূপ পেয়েছে এ দমন-পীড়ন। অর্থাৎ এ ধরনের ঘটনায় জড়িতদের শুধু পরিচয় পাল্টেছে। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাংবাদিকদের হয়রানির প্রধান অস্ত্র ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)। তবে এখন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ মামলাই হচ্ছে হত্যা ও হামলার অভিযোগে।'

প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, 'অভ্যুত্থানের সময়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত কয়েক মাস ধরে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোতে অনেক সাংবাদিককে জড়ানো হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরাও যে প্রশ্নের উত্তর দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তা হলো: সাংবাদিকতা কি হত্যায় প্ররোচনা দিতে পারে?’