
দিনাজপুরের বাসিন্দা রাহেলা বেগমের হাতের আঙুলের ফাঁকে ছোট ছোট ফোসকার মতো দেখা দেয়। তীব্র চুলকানির সঙ্গে আস্তে আস্তে ক্ষত তৈরি হয়ে আঙুল থেকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। মায়ের কাছ থেকে আক্রান্ত হন তার ছেলে রিফাত ইসলাম।
রিফাত বলেন, ‘এসব উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি জানান আমরা ছোঁয়াচে রোগ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন, ক্রিম লাগিয়ে এবং ব্যবহৃত কাপড়, বিছানার চাদর সবকিছু পরিচ্ছন্ন করে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি।’
দেশের বেশ কিছু জায়গায় ছোঁয়াচে রোগ স্ক্যাবিসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে আক্রান্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা, কুমিল্লা, দিনাজপুরসহ দেশের বেশ কিছু জায়গায় স্ক্যাবিস আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। ছোঁয়াচে হওয়ার কারণে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রামক এ রোগ।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া নয়, ছোঁয়াচে রোগ স্ক্যাবিস এক ধরনের পরজীবীর কারণে হয়। আমার ৪২ বছরের কর্মজীবনে এত বেশি স্ক্যাবিস আক্রান্ত রোগী দেখিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, মেসে বসবাসকারী শিক্ষার্থী, মাদরাসার শিক্ষর্থী, হোস্টেলে থাকা কর্মজীবী নারী-পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। গার্মেন্টস কর্মী, বস্তিতে বসবাসকারী বাসিন্দারা আক্রান্ত হচ্ছেন। গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকলে, কাপড় পরিচ্ছন্ন না রাখলে, নিয়মিত সাবান দিয়ে গোসল না করলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। শিশু, বয়স্ক এবং যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা বেশি আক্রান্ত হন।’ এ চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘স্ক্যাবিসের প্রচলিত মুখে খাওয়ার ওষুধ, লোশন, ক্রিমগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ছে। তাই এ রোগ প্রতিরোধী কার্যকর ওষুধ খুঁজে বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পরিবারে একজন আক্রান্ত হলে পুরো পরিবারকেই চিকিৎসার আওতায় নিতে হবে। বারবার স্ক্যাবিস আক্রান্ত হলে রোগীর কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এজন্য এ রোগের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।’ আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রতিনিধি রায়হান ইসলাম জানান, রাবিতে গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী আক্রান্ত হচ্ছেন। শিক্ষার্থী রেদোয়ানুল হক জানান, প্রথমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চুলকাচ্ছিল। তারপর পিঠে মেরুদণ্ডের ওপরে-নিচে ও বগলে র্যাশ বের হয়। রাতের বেলা প্রচণ্ড চুলকায়। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাশিহুর রহমান বলেন, ‘গত এক সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে প্রায় ৩০০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যথাযথ চিকিৎসা নিলে কয়েকদিনের মধ্যেই এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে একজন বারবার আক্রান্ত হতে পারে। সেজন্য সতর্কতার বিকল্প নেই।’ স্ক্যাবিস রোগের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘স্ক্যাবিস বা খোসপাঁচড়া একটি অত্যন্ত সংক্রামক চর্মরোগ, সারকোপটিস স্ক্যাবি নামের এক ধরনের মাইক্রোস্কোপিক পরজীবী প্রাণীর কারণে হয়। এ পরজীবী মানুষের ত্বকের ওপরের স্তরে বাসা বেঁধে ডিম পেড়ে বংশবিস্তার করে, ফলে তীব্র চুলকানি, লাল ফুসকুড়ি এবং ছোট ছোট ফোসকার সৃষ্টি হয়। রোগটি সাধারণত হাতের আঙুলের ফাঁক, কবজি, কোমর, নিতম্ব এবং যৌনাঙ্গের চারপাশে বেশি দেখা যায়। রাতে এই চুলকানি তীব্র আকার ধারণ করে, যা রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে এ রোগটি আগে দেখা গেলেও মাঝে অনেক কমে গিয়েছিল। এ রোগটির বর্তমান বিস্তার হয়েছে প্রধানত টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে।’