
ইউরোপগামী অভিবাসীদের জনপ্রিয় গন্তব্য ইতালির ভিসা পেতে অপেক্ষায় থাকা প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর ভাগ্য নির্ধারণ আজ। উন্নত জীবনের আশায় বৈধ পথে দেশটিতে যেতে অর্থকড়ি বিনিয়োগ করেছেন তারা। কিন্তু দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের ভুলে ভিসা পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষায়! ভুক্তভোগী এবং সরকারের সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন আজ থেকে শুরু হওয়া ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে এ নিয়ে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে। দুইদিনের সফরে আজ ঢাকা আসছেন ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাতেও পিয়ান্তেদোসি। সফরে নিয়মিত ও বৈধ অভিবাসন নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হবে। অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে দেশটির কঠোর পদক্ষেপের কথা তুলে ধরা ছাড়াও সরকারের সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন ভিসার জন্য অপেক্ষমাণ নিরীহ বাংলাদেশিদের বিষয়ে ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সদয় নির্দেশনা দিবেন। সফরকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হবে তার। তাছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ড. আসিফ নজরুল আজ দেশে ফিরলে কাল তার সঙ্গে ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেখা হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইতালি যেতে আগ্রহী বাংলাদেশি কর্মী যাদের ভিসা অপেক্ষমাণ (পেন্ডিং) সেটি সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নিয়মিত তাগাদা দিয়ে আসছে। এ সমস্যা সমাধানে রোমের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ থাকবে। আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালিতে যাওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রবল। ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে অনেক বাংলাদেশি মারাও যাচ্ছেন। সে কারণে বাংলাদেশ থেকে বৈধপথে ইতালি যাওয়ার জন্য দেশটির পক্ষ থেকে তাগিদ দেয়া হচ্ছে। ইতালির মন্ত্রী বৈধ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা তুলবেন অবশ্যই। সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন- এক বছরের বেশি সময় ধরে ভিসা জটিলতা অব্যাহত রয়েছে। ভিসা পেতে দেরি হওয়ায় গত বছরের এপ্রিল মাসে ঢাকায় ইতালি দূতাবাসের সামনে মানববন্ধন করেন ভিসা আবেদনকারীরা। ভিসা পেতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হওয়ার কারণে নানা ধরনের জটিলতার মুখে পড়েছেন বাংলাদেশি কর্মীরা; ঠিক সময়ে যেতে না পারলে ইউরোপের দেশটিতে শ্রম বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ার শঙ্কার কথাও বলছেন কেউ কেউ। জটিলতা নিরসনে দুই দফায় পৃথক ব্যবস্থা নিয়েছে ভিসা প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান ভিএফএস গ্লোবাল। ই-মেইলে ভিসা আবেদনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট এবং আবেদন নিয়ে পাসপোর্ট ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেছে তারা। দেশ জুড়ে কর্মী সংকট কাটাতে দুই বছর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলো থেকে প্রায় ছয় লাখ কর্মী নেয়ার ঘোষণা দেয় ইতালি। এর ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে কর্মী নিতে আবেদন করেন দেশটির বিভিন্ন খাতের মালিকরা। স্থানীয় প্রশাসনের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষে সেসব কর্মীর জন্য ‘নুল্লা ওস্তা’ (ওয়ার্ক পারমিট) ইস্যু করা হলেও দীর্ঘ সময় ধরে তাদের পাসপোর্ট আটকে রাখছে ঢাকাস্থ ইতালি দূতাবাস। বিষয়টি নিয়ে হতাশায় ভুগছেন ইতালিয়ান মালিক এবং বাংলাদেশি কর্মীরা। দূতাবাসের তরফে এটা প্রায়শই বলা হয় যে, ‘জাল নুল্লা ওস্তার’ মাধ্যমে অনেকে ভিসা আবেদন করায় আবেদন প্রক্রিয়াকরণে এত জটিলতা তৈরি হয়েছে। প্রায় এক লাখের মতো আবেদনকারীর পাসপোর্ট দূতাবাসে ছিল এক বছর আগে। এখন সেটি অর্ধেকে নেমেছে। নুল্লা ওস্তাসহ অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করার সময় তারা অনেক ‘জাল নুল্লা ওস্তা’ পেয়েছে জানিয়ে দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছেন- যাদের যাচাই-বাছাই শেষ হয়েছে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সঠিক কাগজ থাকলে তারা ভিসা পেয়েছেন। আর জাল নুল্লা ওস্তা হলে তারা ভিসা ছাড়া পাসপোর্ট ফেরত পেয়েছেন। ফলে এখন সেই সংখ্যা ৫০ হাজারে নেমে এসেছে।
কী বলছে ভিএফএস গ্লোবাল
ইতালিতে যেতে ইচ্ছুক প্রবাসী কর্মীদের ভিসা পেতে বিলম্বের বিষয়ে একাধিকবার ব্যাখ্যা দিয়েছে ভিসা আবেদনপত্র ও ডকুমেন্টস প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান ভিএফএস গ্লোবাল। এক বিবৃতিতে বলা হয়, একটি দায়িত্বশীল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত ভিসা আবেদনকারীদের সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে করে তারা সতর্ক থাকেন এবং শেষ মুহূর্তের সমস্যা এড়াতে জলদি ভিসার জন্য আবেদন করেন। গত ৩১শে মার্চ থেকে ইতালির ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রে নতুন ই-মেইল ভিত্তিক অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকিং সিস্টেম চালুর কথা জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, বৈধ ‘নুল্লা ওস্তা’ থাকা আবেদনকারীদের ই-মেইলে তাদের অ্যাপয়েন্টমেন্টের তারিখ ও সময় জানানো হচ্ছে। ‘নুল্লা ওস্তার’ বৈধতা ইতালীয় দূতাবাস যাচাই করে এবং অ্যাপয়েন্টমেন্টের সংখ্যাও তারাই নির্ধারণ করে। ‘নুল্লা ওস্তা’ পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে আবেদনকারী যদি সঠিকভাবে মেইল করলে ওই ‘নুল্লা ওস্তা’ বাতিল হয় না। আবেদনকারীদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে ভিএফএস গ্লোবাল বলছে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট গ্রহণের অন্য কোনো উপায় নেই, প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। যারা ভিন্ন তথ্য পাচ্ছেন, (তাদেরকে) প্রতারণা বা অননুমোদিত মধ্যস্থতাকারীদের বিশ্বাস না করে, ভিএফএস গ্লোবাল এবং ইতালির দূতাবাসে রিপোর্ট করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। স্মরণ করা যায়, জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনাময় গন্তব্য ইতালি চলতি বছর স্পন্সর ভিসায় বিভিন্ন দেশ থেকে ১ লাখ ৯১ হাজারের বেশি শ্রমিক নেবে। তবে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো সেই তালিকায় বাংলাদেশি নেই। ফলে হাজার হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী বেছে নিচ্ছেন অবৈধ পথ। দেশটিতে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ ভিসার দ্বার খুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের আরও জোরালো পদেক্ষেপ কামনা করেছেন। সূত্র মতে, সম্প্রতি ইতালির নতুন অভিবাসন নীতি কার্যকর হয়েছে। এই নীতির আওতায় আলবেনিয়া হয়ে অবৈধ বাংলাদেশিদের ঢাকায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ইতালির জর্জা মেলোনির সরকার। অবৈধ অভিবাসীদের আলবেনিয়ায় পাঠানোর সিদ্ধান্তসহ কঠোরতার খড়গ যাতে বাংলাদেশিদের ওপর না পড়ে সে বিষয়ে সফরে আসা দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে ঢাকা।