
এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। বাংলাদেশের লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যার সম্মানজনক, টেকসই ও স্বেচ্ছাপূর্ণ সমাধান, দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য একটি সহনশীল কাঠামো নিশ্চিত করা, স্থানীয় জনগণ ও রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা রক্ষা করা, টেকনাফ অঞ্চলের পরিবেশগত ক্ষতি কমানো, অর্থনীতিতে প্রভাব হ্রাস, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা, এবং রোহিঙ্গারা যেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে না বসে—এসব নিশ্চিত করা যতদিন না তারা নিজ দেশে ফিরে যায়।
এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও রাখাইনে ফিরে যায়নি; বরং জুলাই বিপ্লবের পর প্রায় ১,১৩,০০০ নতুন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং এই প্রবাহ এখনও থামেনি। এই অবস্থায় জাতিসংঘ বাংলাদেশ ও মিয়ানমার/রাখাইনের মধ্যে একটি মানবিক করিডর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে মানবিক করিডরের বৈশিষ্ট্যগুলো আগে বোঝা যাক, তারপর বাংলাদেশ ও রাখাইনের মধ্যে এমন একটি করিডর স্থাপনের বাস্তবতা ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
মানবিক করিডরের কোনো নির্ধারিত সংজ্ঞা নেই, এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইনেও এটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। সাধারণভাবে, একটি মানবিক করিডর হলো একটি অস্থায়ী, নিরস্ত্রীকৃত এলাকা বা পথ—যেটি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সম্মতিক্রমে স্থাপিত হয়। এর উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধ বা সহিংসতার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের জন্য সহায়তা নিশ্চিত করা, তাদের জন্য ত্রাণ, ওষুধ, জরুরি সামগ্রী পৌঁছানো এবং প্রয়োজনে অসহায়দের উদ্ধার ও স্থানান্তর করা।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস (ICRC)-এর মতে, মানবিক করিডর বা নিরাপদ পথ হলো সশস্ত্র বিরোধে জড়িত পক্ষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে নির্ধারিত কোনো সময় ও এলাকায় নিরাপদ চলাচলের সুযোগ। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া যায়, ত্রাণ পাঠানো যায়, কিংবা আহত ও মৃতদের উদ্ধার করা যায়।
তবে একটি মানবিক করিডর গঠনের জন্য কিছু পূর্বশর্ত পূরণ জরুরি। এসব শর্ত হলো:
• করিডর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। লিখিত একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি সবচেয়ে উপযুক্ত।
• করিডরের শর্ত, পরিধি, ব্যবহার (কে ঢুকতে পারবে, কী বহন করা যাবে), নির্ধারিত এলাকা, নিরাপত্তা ও তদারকি ব্যবস্থা, সময়সীমা (অপারেশন চালুর সময় ও পুনরাবৃত্তি থাকবে কিনা), এবং করিডর ব্যবহারে কোনো পক্ষের আলাদা শর্ত—এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের বিস্তারিত সম্মতি থাকতে হবে। সব পক্ষকেই নিশ্চিত করতে হবে যে, করিডরের ব্যবহার হবে সম্পূর্ণ বেসামরিক ও মানবিক; অস্ত্র বহন থেকে বিরত থাকতে হবে।
• চুক্তিটি সাধারণত উচ্চ পর্যায়ে স্বাক্ষরিত হলেও তা বাস্তবায়ন করবে মাঠপর্যায়ের বাহিনী। তাই চুক্তির বিস্তারিত তথ্য মাঠপর্যায়ের সেনা, ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ ও মানবিক সহায়তা প্রদানকারীদের কাছে যথাসময়ে পৌঁছাতে হবে, যেন তারা ত্রাণ পরিবহন বা করিডর থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারে।
• করিডর স্থাপনের আগে প্রেক্ষাপটের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করতে হবে এবং এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে রাখাইনে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা এই নিরস্ত্রীকৃত করিডরকে বাংলাদেশে ঢোকার পথ হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে।
• করিডরকে নিরাপদ, ব্যবহারযোগ্য, প্রবেশযোগ্য ও কার্যকর রাখতে হবে। যাতায়াতের পুরো পথজুড়ে, অর্থাৎ করিডরে প্রবেশ থেকে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত, ব্যবহারকারীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ত্রাণ পরিবহনের জন্য করিডর ব্যবহৃত হলে, তা যেন নিরাপদ, দ্রুত ও বাধাহীনভাবে গন্তব্যে পৌঁছায় এবং সঠিকভাবে বিতরণ হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অনুমোদিত ত্রাণকর্মীদের মুক্তভাবে চলাচলের নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
• আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের নীতিমালা অনুযায়ী বেসামরিক জনগণ ও তাদের সম্পদের প্রতি সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এতে পার্থক্য, সতর্কতা ও আনুপাতিকতার নীতি মেনে চলতে হবে।
• কখনো কখনো কোনো পক্ষ করিডর চুক্তিকে ব্যবহার করে তাদের সামরিক, রাজনৈতিক বা কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য কোনো এলাকা ইচ্ছাকৃতভাবে জনশূন্য করে দিতে পারে।
গত কয়েক দশকে মানবিক করিডর বহু মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছে। মানবিক করিডর বা নিরাপদ যাতায়াত পথের ব্যবহার প্রথম দেখা যায় ১৯৩৬ সালে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়। তখন ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য রেড ক্রস (ICRC) মাদ্রিদ থেকে ভ্যালেন্সিয়ায় কিছু নারী, শিশু ও বৃদ্ধকে সরিয়ে নেওয়ার অনুমতি পেয়েছিল।
১৯৪৬, ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ICRC প্রায় ৩৭,০০০ ডাচ ও ইন্দো-ডাচ আটক ব্যক্তি এবং ১,২০০ চীনা নাগরিককে সরিয়ে নেয়।
২০১৬ সালে ICRC ও সিরিয়ান আরব রেড ক্রিসেন্ট মিলে সিরিয়ার সংঘর্ষপূর্ণ এলাকা থেকে ২৫,০০০ এর বেশি মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়।
২০২২ সালের মার্চ থেকে ICRC ইউক্রেনের সুমি ও মারিউপোল থেকে হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কাজ করছে। ওই বছরই ICRC, সংঘর্ষরত পক্ষ এবং জাতিসংঘের সমন্বয়ে ইউক্রেনের যুদ্ধ এলাকা থেকে সাধারণ মানুষের সরিয়ে নেওয়ার জন্য নিরাপদ যাতায়াত কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
এই উদাহরণ ও সংজ্ঞাগুলো মাথায় রেখে এবার রাখাইন অঞ্চলের ভূকৌশলগত অবস্থা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ জটিলতা এবং বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো মূল্যায়ন করা যাক।
বর্তমানে আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইনের প্রায় সব এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে—এর মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ কেন্দ্র, অবকাঠামো, অর্থনৈতিক কেন্দ্র, সড়ক ও নদীপথ, সীমান্ত পোস্টসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। তারা এখন রাজ্য পরিচালনার চেষ্টা করছে।
রাখাইন এখন চীন ও ভারতের জন্য কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে এই অঞ্চলে—বিশেষ করে কিয়াউকফিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পসহ। চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের (CMEC) মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে চীনের প্রবেশ পথও এখানেই।
মিয়ানমারের কিয়াউকফিউ থেকে চীনের কুনমিং ও নানিং পর্যন্ত গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন যথাক্রমে ২০১৪ ও ২০১৭ সাল থেকে চালু রয়েছে। ইয়ুনান–মান্দালয়–রাখাইন পথ, যা বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত যায় এবং এখন এএ-এর নিয়ন্ত্রণে, সেটিই চীনের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে ইয়ুনান–মান্দালয়–ইয়াঙ্গুন পথের তুলনায় বেশি সুবিধাজনক। ফলে চীন রাখাইনকে তাদের একটি কৌশলগত ঘাঁটি হিসেবে দেখছে এবং এএ-এর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছে যেন তাদের বিনিয়োগ নিরাপদ থাকে।
ভারতও কলাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট পরিবহন প্রকল্প (KMTTP) বাস্তবায়ন করছিল, যাতে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সাতটি উত্তর-পূর্ব রাজ্যকে সাগর, নদী ও সড়কপথে যুক্ত করা যায়। এই পথও এখন এএ-এর নিয়ন্ত্রণে। এএ শুধুমাত্র রাখাইন নয়, বরং চিন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর পলেটোয়াও (যা KMTTP-এর অংশ) নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা এখন রাখাইনের রাজধানী সিত্তে দখলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সিত্তে বন্দর এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই বন্দরের পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে ভারতীয় বন্দর ও জাহাজ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ১০০ শতাংশ মালিকানাধীন সংস্থা ‘ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড’।
১৯৯৮ সালের অপারেশন লিচ এবং ২০১৯ সালের অপারেশন সানরাইজের সময় এএ-এর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত এএ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করছে, যাতে রাখাইনে তাদের বিনিয়োগ নিরাপদ থাকে।
ফলে চীন ও ভারত উভয়ের লক্ষ্য এখন রাখাইনে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং এএ-সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করা।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে মিয়ানমার, আরাকান আর্মি (এএ) ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দক্ষিণ এশিয়া-ভিত্তিক কৌশলের অংশ হিসেবে সক্রিয়ভাবে জড়িত। রাখাইনে বর্তমান অস্থির পরিস্থিতি চীনের স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ায় ভবিষ্যতে এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন এখনো তাদের দক্ষিণ এশিয়া-নীতি পুরোপুরি প্রকাশ করেনি (তাদের মনোযোগ এখন মূলত দেশের ভেতরে কেন্দ্রিত), চীনের প্রভাব প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ মিয়ানমার বা রাখাইন থেকে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কয়েকটি প্রতিনিধি দলের সাম্প্রতিক সফর কি বাংলাদেশ-মিয়ানমার-রাখাইন-রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়? এই সফর কি রাখাইনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে আলোচিত মানবিক করিডর গঠনের সম্ভাবনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত?
এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা কাজে লাগিয়ে একটি কৌশলগত সুযোগ খুঁজে পেতে পারে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে কিছু প্রশ্ন বিবেচনায় নেওয়া জরুরি:
রাখাইনের ১৮টি টাউনশিপের মধ্যে ১৫টির নিয়ন্ত্রণ যেহেতু এখন আরাকান আর্মি বা তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার—আরাকান পিপলস রেভল্যুশনারি গভর্নমেন্ট (APRG)/ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ULA)-এর হাতে, এই প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পদক্ষেপ কী হতে পারে?
এই দেশগুলো কীভাবে তাদের নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার-রাখাইন-রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে নিজ অবস্থান গ্রহণ করবে বা সম্পৃক্ত হবে?
মিয়ানমার ইস্যুতে চীন ও ভারতের মধ্যে কোনো মতৈক্য তৈরি হতে পারে কি? তারা কি যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকাতে একসঙ্গে কোনো উদ্যোগ নিতে পারে?
যুক্তরাষ্ট্র কি বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরমুখী নীতির মধ্যেও ‘বার্মা অ্যাক্ট’ ও ‘রোহিঙ্গা অ্যাক্ট’ কার্যকরভাবে চালু রাখবে?
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর ও রাখাইনে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব কি রাখাইনে বিশ্বশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপের আগ্রহের প্রতিফলন, নাকি এটি বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রতিক্রিয়া?
আমরা কি মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধে একভাবে জড়িয়ে পড়ছি?
আরসা কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু জুনুনির গ্রেপ্তার কি আরাকান আর্মির সঙ্গে আস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যতে মানবিক করিডর বাস্তবায়নের পথে প্রস্তুতির অংশ?
যদি বাংলাদেশ ও রাখাইনের মধ্যে একটি মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার কথা হয়, তাহলে দুই দেশের মধ্যে স্পষ্ট শর্তাবলী ও চুক্তি প্রয়োজন।
এই চুক্তিতে মিয়ানমারের পক্ষে কারা থাকবে—তাতমাদাও (সেনাবাহিনী), আরাকান আর্মি, নাকি দু’পক্ষই?
বাংলাদেশ বা জাতিসংঘ কি একটি অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী এএ-র সঙ্গে চুক্তি করতে পারবে?
তাতমাদাও কি আরাকান আর্মিকে চুক্তির এক পক্ষ হিসেবে মেনে নেবে?
মিয়ানমার/রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের সম্ভাব্য ভিন্নমুখী পদক্ষেপের মুখে বাংলাদেশ কীভাবে তার কূটনৈতিক অবস্থান ঠিক করবে এবং নিজের লক্ষ্য অর্জন করবে?
প্রস্তাবিত মানবিক করিডরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমাদের কিছু বিষয় স্পষ্টভাবে জানা থাকা দরকার:
করিডরের উদ্দেশ্য ও পরিধি কী হবে? বলা হচ্ছে, এই করিডরের মাধ্যমে রাখাইনের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হবে। কিন্তু শুধু মানবিক সহায়তা নয়—এই করিডর কি ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার পথও হয়ে উঠবে?
বাংলাদেশ ভূখণ্ডে করিডরের আয়তন, অবস্থান, প্রবেশ ও বের হওয়ার স্থান কোথায় হবে?
রাখাইনে করিডরটি কোথায় গিয়ে শেষ হবে? রাখাইন থেকে মানুষ ও জিনিসপত্র যাতায়াতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন হবে?
এই করিডরের মাধ্যমে কী কী জিনিস সরবরাহ করা হবে?
এই করিডর দিয়ে কাদের সরিয়ে নেওয়া বা আনা হবে?
কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই করিডর পরিচালনা ও তদারকি করবে? সাধারণত, ICRC অতীতে এ ধরনের কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এই করিডর কে ব্যবহার করবে?
যাদের সরানো হবে, যেসব মানবিক কর্মী কাজ করবেন এবং যে সহায়তা যাবে, তাদের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে? এদের গতিবিধি কিভাবে নজরদারি করা হবে? বিমান হামলা, মর্টার শেল বা রাতের অন্ধকার থেকে মানুষ ও মালামালকে রক্ষায় কী ব্যবস্থা থাকবে? করিডর কীভাবে নিরস্ত্রীকৃত রাখা হবে? করিডরের ভেতরে মানুষ ও মালামালের দ্রুত ও বাধাহীন চলাচল কীভাবে নিশ্চিত করা হবে?
আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে চলা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে?
করিডরের কার্যক্রম, বিশেষ করে প্রবেশ ও প্রস্থানের তদারকি কিভাবে হবে?
করিডরের ব্যবহারযোগ্যতা, প্রবেশযোগ্যতা এবং কার্যকারিতা গন্তব্য পর্যন্ত কে নিশ্চিত করবে?
মানবিক সহায়তাকর্মীদের কার্যকর কাজের জন্য তাদের স্বাধীনভাবে চলাচলের নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া হবে?
কী গ্যারান্টি আছে যে এএ বা তাতমাদাও (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) এই করিডরকে ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে উচ্ছেদ করে দেবে না?
এছাড়াও নিরাপত্তা নিয়ে আরও কিছু উদ্বেগের বিষয় রয়েছে, যেমন—মিয়ানমারে সীমাহীন মাদক-সন্ত্রাসের প্রভাব বাংলাদেশের উপর পড়তে পারে, আরাকান আর্মির (AA) দ্বারা সীমান্ত লঙ্ঘন, বাংলাদেশি জেলেদের অপহরণ বা তাদের মাছ ধরা কাজে হস্তক্ষেপ, রাখাইন থেকে চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের সশস্ত্র সংগঠন জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর হাতে অস্ত্র পাচার ইত্যাদি।
এই কঠিন ও জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে প্রতিটি বিষয় দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত যেকোনো মূল্যে জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করা।
আমাদের মানবিক করিডর পরিচালনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তাই এই বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রেক্ষাপট ও সম্ভাব্য সব চ্যালেঞ্জ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করতে হবে।
এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটি জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা জরুরি।