
প্রত্যন্ত গ্রামের একজন সাধারণ গৃহবধূ চেমন আরা বেগম (৭৮)। ১১ সন্তানের মা তিনি। স্বামী মো. আবদুল্লাহ ছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটির কর সংগ্রাহক। টানাটানির সংসারে নিত্যচাহিদা পূরণই যেখানে অনেক কঠিন, সেখানে ১১ সন্তানকে লেখাপড়া করানো অনেকের কাছে কল্পনা মনে হতে পারে; কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী ছিলেন না চেমন আরা। নিজে উচ্চশিক্ষার সুযোগ না পেলেও কঠোর শাসন আর নিয়মানুবর্তিতার জোরে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করিয়েছেন। নিজের জীবনের অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিতে হয়েছে সে কারণে।
মানুষ গড়ার কারিগর এই মা পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘অদম্য নারী’। বেসরকারি বহু সংস্থা ও সামাজিক সংগঠন থেকে রত্নগর্ভা, জাতীয় পর্যায়ের রত্নগর্ভাসহ একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন এই নারী।
চেমন আরার আট ছেলে ও তিন মেয়ের সবাই উচ্চশিক্ষার গণ্ডি পেরিয়েছেন। তাঁরা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে কর্মরত। তাঁর তিন মেয়ের দুজন আছেন শিক্ষকতা পেশায়; আর আট ছেলের সবাই প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ছায়াঘেরা নিভৃত গ্রাম নাইখাইনে চেমন আরার বাড়ি। পাকা সড়ক ধরে ওই বাড়িতে যাওয়ার পথে রয়েছে সবুজে ঘেরা ঝোপঝাড় আর ফসলি জমি। সেখানে গিয়ে জানা গেল চেমন আরার সংগ্রামের গল্প। সে কথা জানার আগে জেনে নেওয়া যাক তাঁর সন্তানেরা কে কোথায় আছেন।
১১ সন্তান কে কোথায়
চেমন আরার ১১ সন্তানের মধ্যে প্রথমজন মোহাম্মদ শহীদ উদ্দিন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক পরিচালক। সম্প্রতি অবসরে গেছেন। শহীদ উদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এবং এলএলবি ডিগ্রি নিয়েছেন। দ্বিতীয় সন্তান মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন সাতকানিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। তিনিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। স্নাতকোত্তর করেছেন হিসাববিজ্ঞান থেকে। তৃতীয় সন্তান মোহাম্মদ শাহীন উদ্দিন লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্বে এমএসএস করেছেন। এরপর পড়েছেন এলএলবি।
চতুর্থ সন্তান পারভীন আকতার, স্নাতক পাস করে নারী উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। পঞ্চম সন্তান মোহাম্মদ আলমগীর, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার (পরিবেশ ও বন) পদে কর্মরত। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বন ও পরিবেশবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। ষষ্ঠ সন্তান সেলিনা আকতার বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন।
সপ্তম সন্তান মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন শিশুরোগবিশেষজ্ঞ। তিনি সিনিয়র কনসালট্যান্ট পদে চট্টগ্রামের সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে কর্মরত। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে শিশুস্বাস্থ্যে এমডি করেছেন। অষ্টম সন্তান অধ্যাপক মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ পটিয়া সরকারি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর।
নবম সন্তান আবু সাদাৎ মুহাম্মদ সায়েম চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। তিনি চুয়েট থেকে যন্ত্রকৌশলে বিএসসি পাস করে জাপানের মনবসু বৃত্তির আওতায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। এরপর অস্ট্রেলিয়া থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। দশম সন্তান রেজিনা আকতার চট্টগ্রামের হোসাইন আহমদ সিটি করপোরেশন স্কুল ও কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেছেন। পাশাপাশি এলএলবিও করেছেন। একাদশ সন্তান মোহাম্মদ ওমর কাইয়ুম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আইইডিসিআরের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার অ্যান্ড রেসিডেন্ট অ্যাডভাইজার পদে কর্মরত। তিনি ঢাকার জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ইন এপিডেমিওলজি ডিগ্রি অর্জন করেন।

জীবন জয়ের গল্প
সম্প্রতি চেমন আরা বেগমের বাড়িতে গেলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর চার ছেলে। তাঁর বড় ছেলে মোহাম্মদ শহীদ উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের বাবা মো. আবদুল্লাহ যখন ক্লাস সেভেনে পড়েন, তখন দাদা বাচা মিয়া মারা যান। বাবার লেখাপড়া তখন খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তবু সরকারি কমার্স কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তবে সংসারের হাল ধরার কারণে পড়তে থাকা অবস্থায় চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটিতে কর আদায়কারী হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। নাইখাইন গ্রামে নিজেদের পুরোনো বাড়ি থেকে একটু দূরে অল্প পরিমাণ জমি কিনে সেখানে দু্ই কক্ষের বেড়ার ঘর তোলেন বাবা। সংসার পাতেন কুঁড়েঘরে। সেই কুঁড়েঘরেই একে একে ১১ ভাই-বোনের জন্ম।’
ছোট ঘর, সামান্য আয়; তবু লেখাপড়া করতেই হবে—এই ছিল চেমন আরার পণ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন সব সন্তান। তখন স্বামীর বেতন ছিল খুবই কম। এ কারণে সংসারে অনাবশ্যক খরচ করা ছিল নিষেধ। সংসার চালাতে চেমন আরা বাড়ির পাশে ছোট জমিতে নিজে চাষাবাদ শুরু করেন। জমি থেকে খাবারের জোগানও হতো অল্পবিস্তর। পাশাপাশি পালতেন হাঁস-মুরগি। তা থেকে আসত ছেলে-মেয়েদের পড়ার খরচ। চেমনের স্বামী আবদুল্লাহ সকালে জমিতে কাজ করে শহরে অফিসে যেতেন। সন্ধ্যায় ফিরে এসে সন্তানদের পড়াতে বসতেন।
কড়া শাসন
চেমন আরা শিক্ষকদের মতো ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার কড়া তদারকি করতেন। তদারকি বলতে তিনি প্রত্যেক ছেলে-মেয়ে ঠিকমতো স্কুলে যাচ্ছে কি না, স্কুল ছুটির পর ঘরে যথাসময়ে ফিরল কি না, এসব। আড্ডা দেওয়া বা সময় নষ্ট করার কোনো উপায় ছিল না। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। ছোট্ট ঘরে রান্নার সময় চুলায় যে আলো হতো, সেখানেই ছেলে-মেয়েদের পড়তে বসাতেন। রান্না শেষ হলে বাইরে হারিকেন জ্বালিয়ে চলত পড়ার কাজ। রান্না করতে করতেই ছেলে–মেয়েদের পড়ার অগ্রগতি জেনে নিতেন তিনি। লেখাপড়ার ফাঁকে বড় দুই ছেলেকে খামারের হাঁস-মুরগি কিংবা চাল বিক্রি করতে পাঠাতেন চেমন আরা। এভাবে সন্তানদের পড়ার খরচ উঠিয়ে আনতেন তিনি।
অষ্টম ছেলে পটিয়া সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘মায়ের এমন কড়া নজরদারি ও ¯কঠোর শাসনের ফলে আজ এতটুকু আসতে পেরেছি। বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। ঈদের সময় বাড়ির পাশের দরজির দোকানে গিয়ে আমাদের সবাইকে একই রঙের শার্ট কিনে দিতেন। এতেই আমাদের খুশি।’
চেমন আরা তাঁর কীর্তির স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ২০২৪ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিভাগীয় পর্যায়ে অদম্য নারী সম্মাননা পান তিনি। জেলা পর্যায়ে হন শ্রেষ্ঠ জয়িতা। এ ছাড়া ঢাকার আজাদ প্রোডাক্টস, মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট তাঁকে রত্নগর্ভা মা সম্মাননা দিয়েছে।