
বাণিজ্য যুদ্ধের উত্তেজনা চড়ছে দ্রুত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন শুল্ক আরোপের হুমকি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই গত ৮ এপ্রিল চীনা কর্মকর্তারা ‘শেষ পর্যন্ত লড়াই’ করার অঙ্গীকার করেন। চীন এর আগে আমেরিকার ৩৪ শতাংশ শুল্কেরও জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর ফলে, আমেরিকান পণ্য আমদানির ওপর চীনের শুল্ক ৭০ শতাংশে পৌঁছায়। একই দিন হোয়াইট হাউস নিশ্চিত করে যে তারা পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। ৯ এপ্রিল থেকে চীনা পণ্যের ওপর ১০৪ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হয়।
পরে ৯ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন, অধিকাংশ দেশের জন্য শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে এবং এই সময়ের জন্য শুল্ক ‘উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে ১০ শতাংশ’ করা হবে। একই সময়ে তিনি জানান, চীনা পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে।
বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে এই দ্বন্দ্ব নিরসনের উপায় আপাতত দেখা যাচ্ছে না। আধুনিক ইতিহাসে বাণিজ্যে এত বড় বিঘ্ন ঘটানোর পেছনে ট্রাম্পের উদ্দেশ্য পুরোপুরি পরিষ্কার না হলেও, মনে হচ্ছে, তিনি চীনের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে আগেরবারের চেয়ে কম আগ্রহী। সর্বশেষ পদক্ষেপগুলো ঘোষণা করার সময় তিনি নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে বলেছেন, চীন যদি ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, তাহলে সমস্ত আলোচনা বন্ধ করে দেওয়া হবে। চীনা কর্মকর্তারা এটিকে ‘ভুলের ওপর ভুল’ বলে অভিহিত করেন, তবে তাঁরা আলোচনার সম্ভাবনা খারিজ করেননি। তা সত্ত্বেও চীনের কঠোর প্রতিক্রিয়া সম্ভবত সেই সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনার আগে পর্যন্ত চীনা পণ্যে ট্রাম্পের শুল্কের জবাবে বেইজিং দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখালেও, তা ছিল সংযত। চীনা কর্মকর্তারা দেখাতে চেয়েছিলেন যে, তাঁরা সহজে নত হবেন না। একই সঙ্গে, তাঁরা এমনভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন যাতে নিজেদের ক্ষতি কম হয় এবং উত্তেজনাও আর না বাড়ে। তাঁদের ধারণা ছিল, এতে সঠিক সময়ে আলোচনার পথ সহজ হবে। এখন অবশ্য মনে হচ্ছে, সেই হিসাব পাল্টে গেছে।
অবস্থান পরিবর্তন করে কঠোর হওয়ার ইঙ্গিতের পেছনে একটি কারণ হতে পারে—চীনা নেতাদের এমন আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে, তাঁরা এই বাণিজ্য যুদ্ধে জিতবেন।
ট্রাম্প তাঁর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছ থেকে অনেক কিছু চান। এর মধ্যে রয়েছে ফেন্টানিল (মাদক) তৈরির উপকরণের প্রবাহ বন্ধ এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ হতে সহায়তা করা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এটাও জানিয়েছেন যে, তিনি টিকটক বন্ধ করার দায়িত্ব নিতে চান না। চীনা মালিকানাধীন শর্ট ভিডিও অ্যাপ টিকটক তরুণ আমেরিকানদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। এমনকি নির্বাচনী প্রচারে টিকটকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে ট্রাম্প নিজেও কথা বলেছেন।
এদিকে, বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার মালিক ইলন মাস্ক ট্রাম্পের উপদেষ্টা। টেসলার ব্যবসার প্রায় এক-পঞ্চমাংশই চীনে। ফলে তারা পাল্টা ব্যবস্থার শিকার হতে পারে, এমন আশঙ্কাও আছে। ফ্রান্সের ব্যাংক নাতিসিসের এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া হেরেরো বলেন, ‘ইলন মাস্ককে (সরকারি দায়িত্ব থেকে) সরে যেতে না বললে এটি মার্কিন সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করে।’
চীনা কর্মকর্তারা হয়তো এটাও বিশ্বাস করেন যে, ট্রাম্পের শুল্কের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অসন্তোষের ধাক্কা আমেরিকা সহ্য করতে পারবে না। তাই মার্কিন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘শেষ পর্যন্ত লড়াই’ করার পরিবর্তে, চীনাদের হয়তো কেবল ততক্ষণ পর্যন্ত লড়তে হবে যতক্ষণ না আমেরিকান ভোক্তাদের জন্য জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করে বা কর্মসংস্থান কমে যায়।
চীনের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, সরকারি গবেষক এবং অর্থনীতিবিদেরাসহ সবাই মনে করেন, ট্রাম্পকে আলোচনার টেবিলে আনার এটিই সবচেয়ে সহজ উপায়। কেউ কেউ পরিস্থিতি আরও খারাপ করার উপায় খুঁজছেন। হয়তো ইউয়ানের মান বাড়িয়ে এটা করা যেতে পারে। এটি অবশ্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। এতে আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি বাড়ার আগেই চীনের শিল্প এবং সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ক্রমে জটিল হতে থাকা বাণিজ্য যুদ্ধের মুখে চীনের অর্থনীতিকে চাঙা করতে প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংকে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। সম্ভাব্য এই ধাক্কাকে ২০০৭–০৯ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে, যা মোকাবিলায় চীন ৪ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (৫৯০ বিলিয়ন ডলার) আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। গত মার্চে সি’র ডেপুটি লি কিয়াং বলেন, তাঁরা ‘প্রত্যাশার চেয়ে বড় ধরনের বাহ্যিক ধাক্কা’ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে নীতি প্রয়োগ করতে প্রস্তুত। তবে বাস্তবে এর অর্থ কী দাঁড়ায়, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম পিপলস ডেইলি গত ৬ এপ্রিল জানিয়েছে, যেকোনো সময় সুদহার ও ব্যাংকের রিজার্ভ অনুপাত কমানো হতে পারে। পত্রিকাটি আরও বলেছে, স্থানীয় সরকারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের দেশে এবং আমেরিকার বাইরে অন্যান্য বাজারে নতুন চাহিদা খুঁজে পেতে সহায়তা করবে। চীনা ব্রোকারেজ ফার্ম সুচৌ সিকিউরিটিজ মনে করে, চীন বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য শুল্কে ছাড় দিতে পারে, একই সঙ্গে রপ্তানিতে ভর্তুকি বাড়াতে পারে।
বিশ্বজুড়ে বাজার যখন টালমাটাল, তখন চীন দ্রুত সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। ৭ ও ৮ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলো চীনের শেয়ারবাজারে শেয়ার কিনতে প্রবেশ করে। এই সহায়তার কারণে ৮ এপ্রিল সাংহাই স্টক মার্কেটের সিএসআই ৩০০ সূচক ১ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, বাস্তব অর্থনীতিতে প্রণোদনা অনেক ধীরে আসবে এবং যেকোনো হস্তক্ষেপের ফলাফল বিরূপ এবং পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পরেই কেবল দৃশ্যমান হবে। ম্যাককুয়ারি ব্যাংকের ল্যারি হু–এর মতে, পরিস্থিতি ভালো হওয়ার আগে আরও খারাপ হবে।
সি চিনপিংকে এটাও ভাবতে হবে, তিনি চীনের অর্থনীতিকে আমেরিকা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া দেখতে রাজি কিনা। যদিও চীন প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করছে, তবুও দেশটি এতদিন ‘বিচ্ছিন্নতার’ ধারণাটিকে মূলত প্রত্যাখ্যানই করেছে। ‘চীনকে বিচ্ছিন্ন করা’ দেশটিকে শাস্তি দেওয়ার পশ্চিমা দুনিয়ার একটি কৌশল হিসেবে দেখেছে বেইজিং। তবে এখন এই ‘বিচ্ছিন্ন’ হওয়ার পক্ষেই সমর্থন বাড়ছে।
গত ৮ এপ্রিল অনলাইনে প্রকাশিত বিভিন্ন সুপরিচিত ভাষ্যকারের এক সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে কিছু পরিকল্পিত পদক্ষেপের আভাস পাওয়া গেছে। এতে বলা হয়েছে, চীন হয়তো ফেন্টানিল নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে সমস্ত সহযোগিতা স্থগিত করার কথা ভাবছে। আরেকটি ভাবনা হলো—আমেরিকার পোলট্রি ও অন্যান্য কৃষিপণ্য যেমন: সয়াবিন ও সরগম (জোয়ার) আমদানি নিষিদ্ধ করা। এসব পণ্য প্রধানত আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির শাসিত রাজ্যগুলো থেকে আসে।
আমেরিকান পরিষেবাগুলোর ওপরও চীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। এই খাতে আমেরিকা এখনো বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত। এর মধ্যে আমেরিকান কনসালট্যান্সি ও আইনি সংস্থাগুলো অন্তর্ভুক্ত, যারা এখনো চীনে কাজ করছে। তারা আমেরিকান সংস্থাগুলোর মেধা সম্পত্তিও তদন্ত করতে পারে। এক প্রভাবশালী ব্লগারের মতে, এই মেধা সম্পত্তিগুলো একচেটিয়া ও অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করছে।
ওই ব্লগার আরও বলেছেন, বক্স অফিসে চীনা অ্যানিমেটেড ফিল্ম ‘নে ঝা ২ ’–এর সাফল্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে ডিজনির ‘স্নো হোয়াইট’–এর দুর্বল অবস্থা আমেরিকান চলচ্চিত্রের আমদানি কমানো বা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার ন্যায্যতা প্রমাণে ভূমিরা রাখতে পারে। যদি ‘শেষ পর্যন্ত লড়াই’ করার অর্থ হয়—আমেরিকার নতুন শুল্কের পাল্টা জবাব দেওয়া, তবে প্রেসিডেন্ট সি–কে বিচ্ছিন্নতার পথেই হাঁটতে হবে।