Image description

বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের দু-একটি বক্তব্য, কমিশনের কিছু সিদ্ধান্ত এবং সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের প্রকাশ্য বিরোধিতার কারণে এ বিতর্কের জন্ম হয়।

ছাত্রদের নব প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি থেকে ইতিমধ্যে অভিযোগ করা হয়েছে, বর্তমান নাসির কমিশন একটি দলের হয়ে কাজ করছে। তবে সিইসি নাসির উদ্দিন বলেছেন, তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করছেন এবং করে যাবেন। নির্বাচন নিয়ে কোনো রাজনৈতিক বিতর্কে জড়াবেন না।

একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য সুন্দর নির্বাচনের জন্য যা করা দরকার, তার কমিশন তাই করবে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত হবে কমিশনের সব সদস্যের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে। এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে না। নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সবার পরামর্শই গুরুত্ব পাবে।

পাঁচ মাসের মাথায় নাসির কমিশনের বিরুদ্ধে একটি ‘বিশেষ দলকে’ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন, ভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে এনআইডি হস্তান্তরসহ বেশ কিছু ইস্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গেও মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ইসির ‘স্বার্থ ক্ষুন্ন’ হবে এমন দাবি করে সেগুলোর বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনকে চিঠিও দিয়েছে। এসব পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ‘একটু বেশি’ স্বাধীনতা ভোগ করছেন বলে অভিযোগ করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।

এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তাদের নিয়ে যে নেতিবাচক কথা বলা হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ অমূলক। তারা কোনো একটি দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আগ বাড়িয়ে কোনো কাজ করছে না।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। এর একমাস পর ৫ সেপ্টেম্বর ‘খলনায়ক সিইসি’ হাবিবুল আউয়াল কমিশন পদত্যাগ করে। এরপর আড়াই মাস কমিশনবিহীন থাকার পর সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন গঠিত নতুন নির্বাচন কমিশন গত ২৪ নভেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেনÑ সাবেক অতিরিক্ত সচিব আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানের মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তহমিদা আহমদ এবং অবসারপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।

দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই গণমাধ্যমকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। শপথকে সমুন্নত রাখতে চান বলে দেশবাসীকে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে তিনি বলেন, সবার সহযোগিতা নিয়ে আমরা এই জাতিকে একটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন উপহার দেব।

দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন নির্বাচন কমিশন সবার আগে ভোটার তালিকার ওপর গুরুত্ব দেয়। কমিশন আইন অনুযায়ী ২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি খসড়া ও ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে একটি ‘নির্ভুল’ ভোটার তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে নতুন করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ভোটার হালনাগাদের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বর্তমানে হালনাগাদের এ কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

বিগত কয়েকটি ইসির ধারাবাহিকতায় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন দলকে নিবন্ধন দেওয়ার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে ইসি। ওই গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রত্যাশিত দলগুলোর আবেদন জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল ২০ এপ্রিল। প্রথমে সময় না বাড়ানোর বিষয়ে ইসি কঠোর অবস্থানে থাকলেও তার থেকে সরে আসে। আবেদন জমা দেওয়ার শেষদিনে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির একটি প্রতিনিধি দল ইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। পরে আবেদনের সময় নতুন করে দুই মাস বাড়িয়ে ২২ জুন পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করতে একাধিক বিকল্পের মধ্যে প্রক্সি ভোটের বিষয় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে ইতোমধ্যে মতবিনিময়ও করেছে। তবে প্রবাসীদের ভোটদানের সুযোগ সৃষ্টিতে প্রথম দিকে যতটা সক্রিয় মনে হয়েছিল বর্তমানে তা দেখা যাচ্ছে না। জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে আইনগত নানা জটিলতা থাকায় পাইলটিং হিসেবে দু’একটি রাষ্ট্রে অবস্থানরত প্রবাসীদের এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার নতুন চিন্তা করা হচ্ছে। হাতে গোনা এ কয়েকটি কার্যক্রমের বাইরে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ইসির দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। অবশ্য অভ্যন্তরীণ নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নির্বাচনী সামগ্রী কেনাকাটার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ভোটের সামগ্রী চাহিদা নিরূপণে একাধিক বৈঠকও তারা করেছে।

দলীয় বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে নির্বাচনী আসন নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও নতুন সীমানা বিন্যাসের খুব একটা অগ্রগতি নেই ইসির। অবশ্য বিদ্যমান সীমানা আইনে ত্রুটি থাকায় তা সংশোধনের জন্য অধ্যাদেশের খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো হয়েছে। জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ গতকাল উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি হবে। নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য গতকাল ৬ মে অনুষ্ঠেয় উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন হয়েছে। এদিকে ইসির উদ্যোগ না হলেও দেশের প্রত্যাশিত প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টরা স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনশ’ আসনের মধ্যে ৬২টি আসন থেকে ৪শ’টির মতো আবেদন জমা পড়েছে। জানা গেছে, সীমানা বিন্যাস সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু হলে এ আবেদনগুলো বিবেচনায় নেওয়া হবে। অবশ্য আইন অনুযায়ী নতুন খসড়া সীমানা প্রকাশের পর তার ওপর দাবি আপত্তির সময় নিয়ে ইসি থেকে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। তখন ভুক্তভোগীরা আনুষ্ঠানিক আবেদন করতে পারবেন।

নাসির কমিশন বড়সড় বিতর্কে জড়িয়েছেন জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়, এনআইডি ভিন্ন সংস্থার কাছে হস্তান্তর এবং সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে। সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করেছিল একাধিক সংস্কার কমিশন। কমিশনের সুপারিশের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হলে বাদ সাধে নির্বাচন কমিশন। ইসি থেকে সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয় তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে কোনো চিন্তা করছে না। তাদের অগ্রাধিকার সংসদ নির্বাচন। সেই লক্ষে তারা প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। উল্লেখ্য, বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ঘোর আপত্তি জানিয়েছে। অপরদিকে জামায়াত ইসলামী, এনসিপি ও কিছু ইসলামিক দল আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেয়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকার ও কমিশনের মধ্যে এক ধরনের টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণসহ একাধিক অনুষ্ঠানে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। এ সময়সীমার বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। তবে, নির্বাচন কমিশন সরকারের ঘোষিত সময়ের মধ্যে ‘ডিসেম্বর’কে প্রাধান্য দিয়েছে। তারা বার বার বলছেন ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে কমিশন সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ওই নির্বাচনের জন্য তারা জুন-জুলাই মাসে নির্বাচনী কর্মপরিকল্পনা ঘোষণার কথাও গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। এমন কী গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাতে গেলে কমিশন তাদের মে-জুনের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা জানান বলে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন। তিনি বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে আগামী মে-জুন মাসের মধ্যেই নির্বাচনের জন্য ইসি পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত হবে। বিএনপির এই বক্তব্যের বিষয়ে পরবর্তী সময়ে কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। ‘ডিসেম্বর’-এর মধ্যে ভোট ইসির এই অবস্থানে এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি দল থেকে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। ইসির এই অবস্থানকে এনসিপির পক্ষ থেকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি এই সাংবিধানিক সংস্থাটির নমীয়তার অভিযোগ তোলা হয়েছে। মে দিবস উপলক্ষে দলটির আলোচনা সভায় নতুন এ দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, আমরা নির্বাচন কমিশনে সংস্কার নিয়ে বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছি, ইসি কিছু বিষয়ে দ্বিমত জানাচ্ছে; ইসির বক্তব্য একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তারা একটি বিশেষ দলকে ক্ষমতায় নেওয়ার আয়োজন করছে বলে মনে হচ্ছে।

নির্বাচনের আগে ইসি পুনর্গঠন এবং ইসি সংস্কার করতে হবে উল্লেখ করে তুষার বলেন, সংশয় তৈরি হয়েছে যে এই ইসি আসলে কার ইসি, এই ইসি আসলে কী চায়। এই ইসি দ্বারা আদৌ সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাবে কি না, প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। যে আইন, যে বিধান দ্বারা এই ইসি পরিচালিত হয়, এই বিদ্যমান আইন এবং এই বিদ্যমান বিধানে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

এর আগে গত ২০ এপ্রিল ইসির সঙ্গে বৈঠকের প্রতি ইঙ্গিত করে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গণমাধ্যমকে বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা অনেক কথা ইসি থেকে শুনতে পাই। যেগুলো আমাদের প্রধান উপদেষ্টার থেকে শুনিনি। রোডম্যাপের কথা শুনিনি, ইসি থেকে এসেছে। এজন্য আমরা বলব, কোনো জায়গায় কথা বলার জন্য ইসি নিজেদের জায়গায় সতর্ক থাকবেন।

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে রোডম্যাপ ঘোষণার আগেই নির্বাচনের পথে ডিসেম্বরকে মাথায় রেখে ইসির তৎপরতায় সন্দেহজনক বলে দলটির অভিযোগ।

অবশ্য সর্বশেষ নির্বাচন কমিশন থেকে তার বক্তব্যে নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তারা বলছেন, সরকার যেহেতু ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছে। এজন্য প্রথম সময়টাকে ঘিরে তাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।

উল্লেখ্য, বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। অপরদিকে এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি দল মৌলিক সংস্কার শেষ করে যৌক্তিক সময়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে তাদের অবস্থানের জানান দিয়েছে।

সংস্কার কমিশন বিশেষ করে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের বেশকিছু সুপারিশের বিরোধিতা করেছে বর্তমান ইসি। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের বেশকিছু সুপারিশ আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করে গত ১৯ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ইসিকে পাঠিয়েছিল। ওই চিঠির জবাবে ইসি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিতে যেসব সুপারিশকে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বলা হয়েছে, তার অনেকই আশু বাস্তবায়ন নয় দাবি করেছে। এর আগে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল ইসি। ১৮ মার্চ ১০টি ক্ষেত্রে অন্তত ২৮টি সুপারিশের বিষয়ে নিজেদের ভিন্নমত লিখিতভাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে তুলে ধরে ইসি। তাতে বলা হয়, সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে সাংবিধানিক এই সংস্থার স্বাধীনতা খর্ব হবে।

বিগত সরকারের আমলে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা নির্বাচন কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তরে আইন সংশোধন করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার এনআইডি স্বরাষ্ট্র থেকে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি নতুন একটি কর্তৃপক্ষের কাছে তা ন্যস্ত করার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও এনআইডির সুরক্ষার বিষয়টি চিন্তা করে ভিন্ন সংস্থার কাছে তা ন্যস্ত করার সুপারিশ করেছে। তবে, এর তীব্র আপত্তি জানিয়েছে ইসি। বিষয়টি নিয়ে ইসির কর্মকর্তারা কর্মবিরতি, মানববন্ধনসহ আন্দোলন কর্মসূচিও পালন করেছে। কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনও বিষয়টি নিয়ে সরকারকে চিঠিও দিয়েছে। ইসির প্রকাশ্য বিরোধিতায় সরকারের উচ্চমহল খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সরকারের অবস্থান গণমাধ্যমকে ব্যাখ্যাও করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ আমার দেশকে বলেন, আমাদের বুঝতে হবে এখন একটি বিশেষ সময় বিশেষ সরকারের অধীনে দেশ চলছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বাধীন বলেই বেশি স্বাধীনতা দেখানোর সুযোগ নেই। স্বাভাবিক সরকারের সময়ে চাইলে স্বাধীনতা দেখানো যেত কিন্তু এই বিশেষ সরকারের সময় কেউই স্বাধীন বলে আমি মনে করি না। স্বাধীনতা দেখানোরও সুযোগ নেই। সবাইকে সরকারের কথা শুনতে হবে। সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সিডিউল ঘোষণা পর্যন্ত সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সিডিউলের পরে তারা স্বাধীনতা দেখাতে পারে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যেটা করণীয় তা করবে।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তাদের বক্তব্যে কখনো কখনো সীমা-পরিসীমা থাকছে না। তবে আমি যেহেতু সরকারের একটি কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছি। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্বও পালন করেছি। এজন্য তাদের কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য করে বিতর্কে যুক্ত হতে চাই না। এটা আমার জন্য সমীচীনও হবে না।

এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরউদ্দীন পাটোয়ারী আমার দেশকে বলেন, বর্তমান কমিশনের যে সেটআপ রয়েছে এক দলকেই ফেভারিংয়ের মধ্যে দিয়ে সবকিছুই সাজানো হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার থেকে ঘোষণা আসছে না। কিন্তু নির্বাচনসহ যে কোনো ইস্যুতে তারা আগ বাড়িয়ে কথা বলছে। অথচ সংস্কার কমিশন রয়েছে, সেগুলোর সুপারিশগুলো নিয়ে তারা কথা বলছে না। তাদের কার্যক্রম যা দেখছি পুরনো ব্যবস্থার প্রতিফলন।

এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যতদ্রুত সম্ভব নির্বাচনের মাধ্যমে যাওয়া যায় ততই ভালো। সরকার ডিসেম্বর টু জুনের মধ্যে বলেছেন, ওই বক্তব্যের সঙ্গে আমরা দ্বিমত পোষণ করিনি। তবে আমাদের কথা হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিচার, সংস্কার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি নির্বাচনও চলবে। সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করেই যদি আমরা নির্বাচনের দিকেই বেশি ঝুঁকি তাহলে আগেই সেই পুরোনো অবস্থায় ফিরে যেতে হবে।

নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ, এম, এম, নাসিরউদ্দিন আমার দেশকে বলেন, পূর্ণাঙ্গ কমিশনের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

নির্বাচনের সময় নিয়ে ইসির বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার জবাবে সিইসি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার অভিপ্রায় অনুযায়ী এয়োদশ সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হবে। যদি ডিসেম্বরে তিনি চান তাহলে আমাদের প্রস্তুতি রাখতে হবে। অথচ আমাদের বক্তব্য নিয়ে নানা নেতিবাচক সমালোচনা শুনতে পাচ্ছি। আমাদের নিয়ে যে নেতিবাচক কথা বলা হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ অমূলক। আমরা কোনো একটি দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আগ বাড়িয়ে কোনো কাজ করছি না।

তিনি আরো জানান, সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশ রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ থেকে কিছূ সুপারিশ আশু বাস্তবায়নের জন্য আমাদেরকে বলেছে। সুপারিশের তিনটি বিষয়কে আমরা চিহ্নিত করি। এগুলো হচ্ছেÑ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মধ্যে কোনগুলো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, কোনটিতে ইসির ক্ষমতা খর্ব হয় এবং আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছে কোন সুপারিশগুলোতে। বাকিগুলোতে আমরা কোনো মতামত দেইনি। কারণ সেগুলো রাজনৈতিক মতানৈক্য হয়ে আমাদের কাছে এলে আমরা বাস্তবায়ন করব।

ইশরাকের গেজেট নিয়ে বিতর্ক

আদালতের আদেশের প্রেক্ষাপটে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে ইসির গেজেট প্রকাশ নিয়ে নতুন বিতর্কের তৈরি হয়েছে। মেয়াদের শেষ সময়ে এ ধরনের গেজেট প্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এদিকে গেজেট প্রকাশের আগে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামতের জন্য চিঠি লিখলেও তার জবাব পাওয়ার আগেই ইসি গেজেট প্রকাশ করেছে। বিষয়টি নিয়ে খোদ আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল উষ্মা প্রকাশ করেছেন। গত ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশের পরদিন বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন আইন উপদেষ্টা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের প্রয়োজন না হলেও এক্ষেত্রে ইসি মতামত চেয়েছিল। গেজেট প্রকাশ করা হবে নাকি আপিল করা হবে, সে বিষয়ে আমরা ভাবছিলাম। কারণ, মামলার ক্লেম পরিবর্তন হলে গেজেট প্রকাশের সুযোগ থাকে না। তবে, মন্ত্রণালয় মতামত দেওয়ার আগেই গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।

পরে বিষয়টির পাল্টা ব্যাখ্যা দেয় নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের আদেশ অনুযায়ী ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশের বাধ্যবাধকতা ছিল। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের জন্য অপেক্ষা করেও আমরা কোনো সাড়া পাইনি। আমরা ২৭ এপ্রিল বিকাল ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। যেহেতু কোনো উত্তর আসেনি, আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের স্বার্থে গেজেট প্রকাশ করেছি।

গেজেট ১০ দিনের মধ্যে জারির বাধ্যবাধকতা ছিল উল্লেখ করে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ আমার দেশকে বলেন, আমরা বিলম্ব করলে ইশরাক সাহেব আবার আদালতে যেতেন। সেখান থেকে অনুমোদন নিয়ে এলে সেটা আমাদের জন্য সম্মানজনক হতো না। আর যদি গেজেটটি না করতাম, তখন সবাই বলত আমরা আওয়ামী লীগার। আর ইসি সংক্ষুব্ধ না; ইশরাক সংক্ষুব্ধ। তাই আমরা আদেশের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করিনি, এ ধরনের চ্যালেঞ্জ কমিশনকে প্রতি মুহূর্তে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বরং অনেক কথা না বলে, যদি বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের পর যতগুলো নির্বাচন হয়েছে একটা অধ্যাদেশ জারি করে বাতিল করে দিত, তাহলে এতো কিছুর প্রয়োজন হতো না। প্রধান সমস্যা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দল। রাজনৈতিক মতানৈক্য হলেই সবকিছু সম্ভব।