Image description

সাতক্ষীরার তালা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনের ৯ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করতে যান সাংবাদিক রোকনুজ্জামান টিপু। এ সময় তালা উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী এম এম মামুন আলম তথ্য দিতে অস্বীকার করায় সাংবাদিকের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। এ ঘটনায় ২২ এপ্রিল তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মো. রাসেল ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ১০ দিনের কারাদণ্ড দেন কালের কণ্ঠের ওই সাংবাদিককে। যদিও পরে আদালত তাঁকে জামিন দেন।

পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হচ্ছেন সাংবাদিকরা। দেশে আগের সরকারের সময়ে সাংবাদিকরা পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতেন। ভয়ভীতি, হুমকি-ধমকি, মামলা-মোকদ্দমা, শারীরিক নির্যাতনে মারাত্মক জখম থেকে শুরু করে গুম বা খুন পর্যন্ত নির্যাতনের এমন কোনো ধরন নেই, যার শিকার হননি সাংবাদিকরা।  জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর এই চিত্রে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।

বর্তমানে নির্যাতন-হয়রানি কিছুটা কমলেও আশানুরূপ নয়। এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৫। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে তারিখটিকে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর পর থেকে মুক্ত সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের দাবিতে প্রতিবছর এই দিনে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালন করা হয়।

বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে গত বছরের তুলনায় ১৬ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। তবে সূচকে এবারও বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিস্থিতি বেশ গুরুতর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) তাদের ২০২৫ সালের সূচক প্রকাশ করেছে।

সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম, স্কোর ৩৩.৭১। আরএসএফের এ বছরের সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও ভুটানএই তিনটি দেশ বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। ভারতের অবস্থান ১৫১তম, ভুটানের ১৫২তম এবং পাকিস্তানের ১৫৮তম।২০২৪ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫তম, এর আগের বছর ২০২৩ সালে ছিল ১৬৩তম।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিকদেরও রক্ত ঝরেছে এবং তাঁদের অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। এর পরও দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের হামলা-ঘেরাওয়ের হুমকি, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নির্বিচার মামলা ও হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে। পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসনামলে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৪ বছরে ৪২ ধাপ নেমেছিল বাংলাদেশ।

গত বছর ডিসেম্বরে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) ২০২৪ রাউন্ড আপ শীর্ষক প্রতিবেদনে সাংবাদিকদের কাজের জন্য বিপজ্জনক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম এসেছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক ৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে।

আরএসএফের তথ্য মতে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী। এর মধ্যে ২০১৪ সালে একজন, ২০১৫ সালে চারজন সাংবাদিক ও একজন সংবাদকর্মী, ২০১৬ সালে একজন, ২০১৭ সালে দুজন, ২০১৮ সালে একজন, ২০১৯ সালে প্রাণ হারাননি কোনো সাংবাদিক, ২০২০ সালে একজন, ২০২১ সালে তিনজন, ২০২২ সালে একজন, ২০২৩ সালে তিনজন এবং ২০২৪ সালে সাতজন সাংবাদিক ও একজন সংবাদকর্মী প্রাণ হারান তবে ২০২৪ সালের আটজনের মধ্যে শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেই প্রাণ হারান পাঁচজন সাংবাদিক

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে নানা ধরনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে কোনো প্রতিষ্ঠানেই সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় কার্যকর কোনো কাঠামো গড়ে ওঠেনি। এর ফলে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার ঝুঁকি একটুও কমেনি। আগে থেকেই দাঙ্গা-বিক্ষোভে কখনো পুলিশ, কখনো বিবদমান পক্ষের হাতে মার খাচ্ছেন। মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গুম বা অপহরণ হচ্ছেন। এমনকি হত্যার শিকার হচ্ছেন। রেহাই পাচ্ছেন না সম্পাদকরাও।

কাদের গনি চৌধুরী বলেন, সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিরোধী কিছু আইন। তবে সাংবাদিকদের সুরক্ষার কোনো আইন নেই। বিগত সরকারের সময় রাষ্ট্রীয়ভাবেও সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে এখন একটা পরিবর্তন এসেছে। এর পরও যে সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন না, তা আমি বলব না। ফ্যাসিস্ট সরকারের যে দালাল সাংবাদিক নেই, সেটা বলাও আমার জন্য মিথ্যাচার হবে। এসব সুবিধাবাদীকে আমি সাংবাদিক বলতে চাই না। কিন্তু এখন গণহারে সাংবাদিকদের নামে মামলা দেওয়া হচ্ছে। আমি মনে করি, এটাও সাংবাদিক নিপীড়নের আরেকটা ধাপ। বর্তমান সরকারের কাছে আহবান থাকবে, সাংবাদিক নিপীড়নটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

২৭ আগস্ট দিবাগত রাতে হাতিরঝিল থেকে স্থানীয় লোকজন নারী সাংবাদিক রাহনুমা সারাহর লাশ উদ্ধার করে রাহনুমার পরিবার তাঁর এই রহস্যজনক মৃত্যুতে একটি অপমৃত্যুর মামলা করে থানায় ১০ অক্টোবর দীপ্ত টিভির সম্প্রচার কর্মকর্তা তানজিল জাহান তামিমকে বাসায় ঢুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে

১২ অক্টোবর ময়মনসিংহের সদর উপজেলায় বাড়ির সামনে তারাকান্দা প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি স্বপন কুমার ভদ্রকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় পরের দিন হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে সাগর মিয়াকে আটক করে পুলিশ পূর্ববিরোধের জের ও মাদকের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে পত্রিকায় লেখায় তাঁকে হত্যা করা হয়।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি শরীয়তপুরে চিকিৎসায় গাফিলতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সমকালের প্রতিবেদক সোহাগ খানের ওপর একটি ক্লিনিক মালিকের ভাই ও তাঁর সহযোগীরা হাতুড়ি ও ছুরি দিয়ে হামলা চালায়। সোহাগকে রক্ষা করতে গিয়ে তাঁর তিন সহকর্মী নিউজ২৪-এর বিধান মজুমদার, বাংলা টিভির নয়ন দাস এবং দেশ টিভির সাইফুল ইসলাম আকাশও আহত হন।

গত ১৯ মার্চ রংপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে আইনজীবী সহকারী পরিচয়দানকারী এবং তাঁদের সহযোগীদের হামলায় আট সাংবাদিক আহত হন।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু আগের সরকারের সময় গত ১৬ বছর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না। এক ধরনের তেলবাজি সাংবাদিকতা আমরা দেখেছি। তবে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে গত বছরের তুলনায় এ বছর ১৬ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এটা আমাদের জন্য সুখবর। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ কোনোভাবেই আমাদের প্রত্যাশিত নয়। সাংবাদিকরা যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন, সেটাই বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা।