
অর্থনৈতিক সংকটের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে সরকার। ফলে বাজেট বাস্তবায়নে তেমন পরিবর্তন আনতে পারেনি। উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে কেবল পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি সামাল দিতেই চেষ্টা করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ধাপের বাজেট বাস্তবায়নে গতানুগতিক ধারার কচ্ছপ গতি চলছে।যদিও বছর শুরুর আগেই ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। এর পরও আগের বছরগুলোর মতোই চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আট মাসে অর্ধেক বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। গতনুগতিক প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসবে এমন আশা থাকলেও তার বাস্তবায়ন দেখাতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি বছর এমন চিত্র ফুটে উঠেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ২৮ শতাংশ। গত আট মাসে মূল বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের প্রায় ৪৩ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। বাস্তবায়ন হার আট মাসেও বাজেটের অর্ধেকের কম হয়েছে। অর্থ বিভাগের তথ্য বলছে, অর্থবছরের মূল বাজেট সময়মতো যৌক্তিক বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, সংশোধিত বাজেটও অর্ধেক বাস্তবায়ন হয়নি।
যদিও চলতি অর্থবছরের আট মাসে বাস্তবায়নের হার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। আগের অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আট মাসে বাজেট বাস্তবায়ন হার ছিল মূল বাজেটের প্রায় ৩৭ শতাংশ, সংশোধিত বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ। সে হিসাবে উভয় ক্ষেত্রেই চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বাজেট বাস্তবায়ন হার প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিচালন ব্যয় ১৮ শতাংশ বেশি হওয়ায় বাস্তবায়ন হার বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও উন্নয়ন ব্যয় আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮.৬১ শতাংশ কম হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থ ব্যয় না হওয়ার শঙ্কায় চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের বাজেট থেকে ৫৩ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। সংশোধিত বাজেটের আকার কমিয়ে সাত লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, আট মাসে ব্যয় হয়েছে তিন লাখ ১৮ হাজার দুই কোটি টাকা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময় ব্যয়ের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৮৩ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ২৫ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার ছিল সাত লাখ ৬১ হাজার ও সংশোধিত বাজেটের আকার ছিল সাত লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। মোট প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ১১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। এই প্রকৃত ব্যয় হিসাবে গত অর্থবছরের আট মাসে বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ৪৭.৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে মূল বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ৮০ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ৮৫ শতাংশ এবং তার আগের বছরে ছিল ৮৬ শতাংশ। কভিড-১৯-এর সময় ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরেও মূল বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছিল ৮১ শতাংশ। তবে তার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছিল ৮৬ শতাংশ।
অর্থ বিভাগের হিসাব মতে, চলতি অর্থবছরের আট মাসে মোট পরিচালন ব্যয় দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬০ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। এটি সংশোধিত পরিচালন ব্যয়ের ৫১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত পরিচালন ব্যয়ের আকার হচ্ছে পাঁচ লাখ ছয় হাজার দুই কোটি টাকা। মূল বাজেটে এর আকার ছিল পাঁচ লাখ ছয় হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের আট মাসে পরিচালন ব্যয় হয়েছে দুই লাখ ২১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে পরিচালন ব্যয় বেড়েছে ৩৯ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা।
এদিকে আগের বছরের চেয়ে এবার এডিপি বাস্তবায়ন প্রায় পাঁচ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা কম হয়েছে।
অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের আট মাসে এনবিআর আওতাধীন মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে দুই লাখ ৬৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৫৩ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। এই সময় বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ২০২ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট মাসে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে অর্থনীতিতে স্থবিরতা চলে এসেছিল। এটি নভেম্বর মাস পর্যন্ত অনেকটা অব্যাহত থাকায় এডিপি বাস্তবায়নসহ বাজেট বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে উন্নয়ন ব্যয় কমেছে। তবে ঋণ পরিশোধ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও জরুরি সেবার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি হয়েছে। অর্থবছরের প্রথমার্ধে শ্রমিক অসন্তোষের জেরে অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে রাজস্ব আহরণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমছে।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরে সামগ্রিকভাবে অর্থ সংকট থাকায় চ্যালেঞ্জের মুখে বাজেট বাস্তবায়ন। এ ছাড়া বৈদেশিক ঋণ চলতি অর্থবছরে বেড়েছে। এই অর্থ ছাড় ও এর ব্যবহার করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে অর্থায়ন নিয়ে ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।