Image description

আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের পথে হাঁটছে সরকার। প্রস্তাব এসেছে বর্তমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের— ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’। দাবি করা হচ্ছে, এতে কর ও জিডিপি’র অনুপাত বাড়বে, স্বচ্ছতা আসবে এবং জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলে এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে যেমন প্রত্যাশা জেগে উঠছে, তেমনই আশঙ্কা ও বিতর্কও তুলছেন কেউ কেউ।

এনবিআর বিভক্তির পটভূমি

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। বর্তমানে এটি ৮ শতাংশের নিচে। ফলে রাজস্ব ঘাটতির কারণে সরকার উন্নয়ন ব্যয় ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে পারছে না। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বারবার পরামর্শ দিয়ে আসছে, নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নকে পৃথক করতে হবে। তারা যুক্তি দেয়— একই প্রতিষ্ঠানে নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের সমন্বয় করা স্বচ্ছতা ও দক্ষতার পথে বড় বাধা। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এনবিআর বিভক্তির প্রস্তাব এসেছে।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-সহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই নীতি ও বাস্তবায়ন আলাদা করার পরামর্শ দিয়ে আসছে। এমনকি ২০২২ সালে আইএমএফ-এর সঙ্গে সই হওয়া ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির আওতায় এই সংস্কার ‘একটি পূর্বশর্ত’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

প্রস্তাবিত কাঠামো: কী পরিবর্তন আসছে?

‘রাষ্ট্রীয় নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ এর খসড়ায় বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম  জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করা।

প্রস্তাবনায় দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। যার মধ্যে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ কর, শুল্ক, ভ্যাট ও রাজস্ব-সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন, বাজেট প্রস্তুতির ভিত্তি নির্ধারণ, করের হার ও কাঠামো নির্ধারণ, প্রণোদনা পরিকল্পনা ইত্যাদি করবে। অর্থাৎ রাজস্ব নীতি বিভাগ মোটা দাগে নীতি প্রণয়ন, শুল্ক কাঠামো, প্রণোদনা ও বাজেট পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকবে।

আর ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ মূলত বাস্তবায়নের কাজ করবে। কর আদায়, ফাঁকি রোধ, করদাতার তথ্য সংগ্রহ, অডিট, ট্রাইব্যুনাল, মামলাসহ মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এই কাঠামোকে ‘আধুনিক প্রশাসনের প্রতিফলন’ বলছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

এই দুটি বিভাগের নেতৃত্বে থাকবেন আলাদা সচিব, যারা সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করবেন বলেও প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া এনবিআরের বর্তমান কাঠামো (চেয়ারম্যান, সদস্য, বিভাগ) বিলুপ্ত করে তাদের দায়িত্ব নতুন দুই বিভাগে বণ্টন করার কথাও বলা হয়েছে।

সম্ভাব্য ইতিবাচক দিক

এনবিআরের বিভক্তিতে সম্ভাব্য কী কী সুবিধা পাওয়া যেতে পারে? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রথমত এর ফলে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা আসবে। সংস্থার দুই ধরনের কাজ আলাদা হলে নিজেদের কাজের ওপরই ফোকাস বাড়বে। দ্বিতীয়ত, দায়বদ্ধতা বাড়বে। অর্থাৎ যদি রাজস্ব কম আসে, তখন কে দায়ী— নীতি না বাস্তবায়ন? তা স্পষ্ট হবে।

একইসঙ্গে এই পদক্ষেপের ফলে দুর্নীতি কমার সম্ভাবনা আছে বলেও আশা করা হচ্ছে। তারা বলছেন, প্রশাসনিক বিভাজন একাধিক স্তরে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স তৈরি করবে। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের আস্থা অর্জন হবে। এই ধরনের সংস্কার আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের দীর্ঘদিনের সুপারিশ। তা বাস্তবায়ন হলে আন্তর্জাতিক ঋণ ও সহায়তার পথ সহজ হতে পারে।

দুই ভাগ করার পক্ষে সমর্থন ও যুক্তি

বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন পৃথক হলে স্বচ্ছতা বাড়ে এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত হয়।’

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, ‘এটা এনবিআর ভাঙা নয়, বরং নীতি ও বাস্তবায়নের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সীমারেখা টানা।’

তার মতে, সত্যিকারের পৃথকীকরণ মানে হবে— নীতি বিভাগ এনবিআরের অধীনে নয়, সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করবে।

রাজস্ব প্রশাসনে আপত্তি

নানা ধরনের আশা-প্রত্যাশার কথা বলা হলেও এই বিভক্তির বিষয়ে এরইমধ্যে রাজস্ব প্রশাসনেই আপত্তি উঠেছে। বিরোধিতার পেছনে যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, এরফলে বিশেষায়িত দক্ষতা ও নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, দুটি বিভাগের সচিব পদে যেকোনও ক্যাডার থেকে নিয়োগ দেওয়া যাবে। এতে রাজস্ব ক্যাডারের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা অবমূল্যায়িত হতে পারেন।

এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজস্ব প্রশাসন একটি বিশেষায়িত খাত। বাইরের লোক এনে বাস্তব জটিলতা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।’

দ্বিতীয়ত, দ্বৈত কর্তৃত্ব ও সংঘাতের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নীতি বিভাগ প্রয়োগ (বাস্তবায়ন) বিভাগের কার্যক্রম তদারক করবে— এমন বিধান খসড়ায় রয়েছে, যা প্রশাসনিক দ্বৈততা সৃষ্টি করতে পারে। এটি ভবিষ্যতে বিভাগীয় টানাপড়েন ও আইনগত জটিলতায় রূপ নিতে পারে।

প্রতিষ্ঠানিক স্মৃতি ও দক্ষতা হ্রাসের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত এনবিআর একটি কার্যকর ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান। এর ভাঙনে কর প্রশাসনের প্রতিষ্ঠানিক স্মৃতি, দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত কাঠামোর ভাঙন ঘটবে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।

মূল দ্বন্দ্ব: দক্ষতা বনাম আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ

এই প্রস্তাবে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করে যেকোনও প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তাকে সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পথ রাখা হয়েছে, যা মূলত রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষ জনবলের প্রতিস্থাপন ঘটাতে পারে। মাঠপর্যায়ে অভিজ্ঞতা ও নীতিনির্ধারণের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে বাস্তবায়নযোগ্যতা হুমকিতে পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

আইনি ও রাজনৈতিক বিতর্ক

বিশ্লেষকদের একাংশ বলছে, এনবিআরের কিছু ক্ষমতা সংবিধানিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। নির্বাহী অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্ত করলে আইনি প্রশ্ন উঠতে পারে। তাছাড়া, নীতি বিভাগ যদি বাস্তবায়ন বিভাগকে তদারকি করে, তাহলে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, যা প্রশাসনিক সংঘাত ডেকে আনবে।

ব্যবসায়ীদের চাওয়া ও বাস্তবতা

ব্যবসায়ী মহল দীর্ঘদিন ধরেই আলাদা নীতি ও বাস্তবায়ন ইউনিটের দাবি জানিয়ে আসছে। বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘যারা নীতি তৈরি করবেন, তারা প্রয়োগে থাকলে স্বার্থ সংঘাত হতে পারে।’ তবে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জও কম নয়। বর্তমানে এনবিআরের তথ্যপ্রযুক্তি, অডিট কাঠামো ও অভিজ্ঞ জনবল যা আছে, তার পুনর্বিন্যাস ছাড়া দুই বিভাগের দক্ষতা নিশ্চিত করা কঠিন।

সামনের পথ

রাজস্ব প্রশাসন সংস্কারের প্রেক্ষাপটে গঠিত পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ পরামর্শক কমিটি ইতোমধ্যেই তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদের নেতৃত্বাধীন এ কমিটি ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন পৃথকভাবে মতামত দিয়েছে। সম্প্রতি বিসিএস (কাস্টমস ও ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশন তাদের এক বিশেষ সাধারণ সভায় খসড়া অধ্যাদেশে শব্দগত অসঙ্গতিগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা সংশোধনের দাবি জানিয়েছে।

১৭ এপ্রিল অধ্যাদেশের খসড়া আইনি ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি জুলাই থেকেই বাস্তবায়ন শুরু হতে পারে। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুরুটা করতে হবে। বিতর্ক থাকলেও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তা সমাধান হবে।’ তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে—এই রূপান্তর কি সত্যিকারের কাঠামোগত সংস্কার হবে, নাকি তা প্রশাসনিক দ্বন্দ্ব, দক্ষতার ঘাটতি ও আইনি জটিলতার জন্ম দেবে?

উল্লেখ্য, রাজস্ব প্রশাসন পুনর্গঠনের ধারণাটি প্রথম আসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে, ১৯৯৩ সালে। এরপর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিশ্ব ব্যাংকও একই ধরনের সুপারিশ করে।

সব মিলিয়ে এবারের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে রাজস্ব নীতি ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে এক দীর্ঘ প্রতীক্ষিত কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবে পরিণত হবে। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, সংসদীয় আলোচনাকে এড়িয়ে কিংবা স্টেকহোল্ডার ও প্রশাসনের অভিজ্ঞ মতামত উপেক্ষা করে এই সংস্কার এগিয়ে নেওয়া হলে, তা কেবল কাগুজে পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে— যার খেসারত শেষ পর্যন্ত জনগণকেই দিতে হবে।