
কাজল রানী। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। বিধবা কাজলের জীবনসংগ্রামটা একেবারেই অন্য রকম। সংসার সামলিয়ে বাবার ব্যবসাও দেখেন তিনি।
সাগরতীরের জেলা বরগুনার আমতলী পৌর এলাকায় তাঁর বাস। ৮০ বছর বয়সী বাবা অরুণ চন্দ্র মালীর সঙ্গে কাজল রানী কামারের পেশায় যুক্ত। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর বলা চলে কাজল রানী একাই সামলাচ্ছেন বাবার ব্যবসা। লোহা কেনা থেকে শুরু করে দা-কাঁচি তৈরি করা, তাতে শাণ দেওয়া—সব কাজই কাজল করেন।
কাজলের স্বামী-সংসার-সন্তান সবই ছিল। এখন সেসব অতীত। বর্তমান হচ্ছে—দেনার দায়ে একমাত্র ছেলে আত্মগোপনে। ফলে ছেলের স্ত্রী এবং তাঁদের দুই মেয়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্বও কাজলের কাঁধে বর্তেছে।
আমতলী পৌর এলাকার অরুণ চন্দ্র মালী আর দীবা রানীর তিন সন্তানের মধ্যে কাজল রানী দ্বিতীয়। কাজলের বয়স যখন ১২ বছর, ওই সময় বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাঁকে। পাত্র পাশের পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা পৌর এলাকার। দরজির কাজ করতেন। অভাবের সংসারে এমন পাত্র পাওয়া ছিল ভাগ্যের বিষয়। দরজি সঞ্জীব মালীর সঙ্গে বিয়ে হয় কাজলের। বছর ঘুরতে কাজলের কোলজুড়ে আসে ছেলে সজীব মালী।
কিন্তু বিয়ের তিন বছরের মাথায় যক্ষ্মা রোগে মারা যান স্বামী সঞ্জীব। এরপর স্বামীর বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন কাজল। কাজের সন্ধানে ছুটে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় গাছ লাগানো ও পরিচর্যার কাজ পান। বেতন মাসে ৮০০ টাকা। তা দিয়েই চলছিল মা-ছেলের সংসার।
এরপর সংস্থাটির পটুয়াখালীর অফিসে রাঁধুনির কাজ পান তিনি। সেখানে রাঁধুনির কাজ করেই ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছেন। কিন্তু ২০০৮ সালের দিকে প্রতিষ্ঠানটির বেতন অনিয়মিত হয়ে যায়। বিনা বেতনে ওই প্রতিষ্ঠানে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন।
শেষে আর না পেরে পটুয়াখালী থেকে ফিরে আসেন বাবার কাছে। দায়িত্ব নেন বাবার কামারের দোকান পরিচালনার। শুরুর দিকে বাবার দোকানে সরঞ্জাম বিক্রি করতেন। পাশাপাশি বাবা ও বড় ভাই অমল মালীর কাছ থেকে দা-বঁটি শাণ দেওয়া, সংস্কার করার কাজ শিখে নেন।
বড় ভাই অসুস্থ হয়ে পড়েন ২০১৭ সালে। তখন বাবার সঙ্গে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে লোহার সরঞ্জাম তৈরির কাজ শুরু করেন। ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর সংসারের দায়িত্বও এসে পড়ে কাজলের ওপর।
এদিকে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে ঘরে নতুন বউ তুলেছেন। জমানো আর ঋণ করা অর্থে আমতলীতে ছেলেকে একটি ফার্মেসি করে দেন। কিন্তু বছর না ঘুরতেই ছেলের ব্যবসায় ধস নামে। এক পর্যায়ে ছেলে আত্মগোপনে চলে যান।
কাজলের দিনরাত্রি
প্রতিদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বাজারে যান কাজল। বাজার শেষে ঘরে ফিরে ছেলের বউয়ের সঙ্গে রান্নায় হাত লাগান। সকালের খাবার খেয়ে বাবার দোকান খোলেন। দোকানের দা-বঁটি সাজিয়ে রাখেন। এরপর বৃদ্ধ বাবা দোকানে এলে দুজনে মিলে পুরনো দা-বঁটি সারাইয়ের কাজ শুরু করেন। দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলে আবার দোকানে ফেরেন। বাবার সঙ্গে রাত পর্যন্ত কাজ করে তবেই বাড়ি ফিরে যান।
ছেলের বউ কৃষ্ণা রানী কণা বলেন, ‘সংসার চলে মায়ের রোজগারে। সংসার খরচের পর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দোকান ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই। পাওনাদারদের ভয়ে স্বামী এলাকাছাড়া।’
কাজলের মা দিবা রানী বলেন, ‘ছেলে মারা গেছে বছর তিনেক হবে। প্রায় ১৫ বছর ধরে বড় মেয়েই সংসারের হাল ধরেছে। কাজলই আমার মেয়ে, ও-ই আমার ছেলে।’
কাজলের বাবা অরুণ চন্দ্র মালী বলেন, ‘কামারের দোকানে একজন পুরুষ যা করেন, কাজল সেই কাজই করে আমার সঙ্গে। অন্য লোক রাখলে তাকে প্রতিদিন ৮০০ টাকা দিতে হতো। এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। প্রতিবেশীদের অনেকে অনেক কথা বলে। মেয়েকে দিয়ে কেন ছেলেদের কাজ করাচ্ছি। কিন্তু উপায় তো নেই! হাতুড়ি পেটানো অনেক পরিশ্রমের কাজ। বাধ্য হয়ে মেয়েকে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছি।’
কাজলের কথা
বিয়ের পর তিন বছর স্বামীর সংসার করেছি। স্বামী মরে গেলে বাবার ঘরে ফিরে এসেছি। কামারের কাজ কষ্টের। বাঁচার প্রয়োজনে করতে হচ্ছে। রাতে ঘুমাতে গেলে কোমর অবশ হয়ে থাকে। সকালে ওই ব্যথা নিয়েই কাজে যাই। সংসার চলতে হবে যে!
ক্রেতাসাধারণ যা বলছে
আহসান হাবিব নামের এক ব্যক্তি গতকাল বুধবার হাটের দিন দায়ে শাণ দিতে কাজলের দোকানে আসেন। তিনি বলেন, ‘কাজল দায়ে ভালো শাণ দিতে পারেন। তাই ওর কাছে দা নিয়ে আসছি। প্রথম দিকে ভাবতাম, কাজল এই কঠিন কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের সে ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন কাজল।’