
রণসাজের বিউগল বাজছে ভারত-পাকিস্তান ভূখণ্ডে। কাঁটাতারের দুই পারেই যুদ্ধের দামামা। সেয়ানে সেয়ানে টেক্কা। ট্যাংক-টহলের দুর্গম দৌড়ে গমগম করছে লাইন অব কন্ট্রোলের (এলওসি) ৭৮০ কিলোমিটার সীমান্ত। সাম্বা, কাঠুয়া এবং আখনুর সেক্টরের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো খালি করছে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। একই অবস্থা ওপারেও। টানটান উত্তেজনা। মহড়ার গোলাবারুদের ফুলকিতে গনগনে লাল হয়ে উঠছে পরমাণু শক্তিধর দুই শত্রুর কামান-বন্দুকের নল। যুদ্ধ-পারদে দিশেহারা বুটের দাপটে কাঁপছে চেকপোস্ট-টাওয়ারের মাটি। পরিখার আড়ালে বন্দুক তাঁক করে আছে দুপক্ষই। পেছনে ওতপেতে আছে দুদেশ চৌচির করে দেওয়া বিরাট সাঁজোয়া বহরের সারি। মাথার উপরে আকাশ কাঁপিয়ে বিকট শব্দে উড়ছে সামরিক হেলিকপ্টার। পরক্ষণেই আবার সাই করে উড়ে যাচ্ছে বিমানবাহিনীর যুদ্ধদানব। মঙ্গলবার গভীর রাতে এমনই এক টগবগে মুহূর্তে ভারতের ৪ রাফায়েল যুদ্ধবিমানকে একসঙ্গে ধাওয়া করে পাকিস্তান বিমানবাহিনী (পিএএফ)। এলওসিতে হঠাৎ ভারতীয় যুদ্ধবিমানের গন্ধ পেয়ে গর্জে ওঠে পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান। মারমুখী ধাওয়ার মুখে পিছু হটে রাফায়েল। সীমান্ত ছেড়ে ফিরে যায় ঘাঁটিতে। পিটিভি, ডন, জিও নিউজ, এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া।
দিন যেমন তেমন-রাত আরও ভয়ংকর। সন্ধ্যা নামতেই থমথমে সীমান্ত। ভয়ে ঘুম উড়ে যায় দুই জনপদেই। কখন শুরু হবে গোলাগুলি-একে অন্যের চেকপোস্ট লক্ষ্য করে বিরামহীন গুলি! আর ধড়ফড় করে উঠে লুকাবে নিরাপদ আশ্রয়ে। ২২ এপ্রিল বিকালে জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর থেকে নতুন করে এই ‘পুরান আতঙ্ক’ চেপে বসেছে দুই প্রতিবেশীর সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। মঙ্গলবার রাতেও ভারতের চেকপোস্টে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান।
ভারতও পালটা গুলি চালিয়ে জবাব দিয়েছে বলে জানিয়েছে এনডিটিভি। পাকিস্তানের নিরাপত্তা সূত্রের দাবি, লাইন অব কন্ট্রোলের (এলওসি) কিয়ানি ও ম্যান্ডল সেক্টরে বিনা উসকানিতে গুলি চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতীয় বাহিনী ছোট অস্ত্র ব্যবহার করে সীমান্ত এলাকায় হামলা চালায়। এরই জবাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কঠোর পালটা প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং একাধিক ভারতীয় চৌকিতে পালটা হামলা চালায়। ফলে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ‘চাকপুতরা’ পোস্ট ধ্বংস হয়ে গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। একেবারে আগ্নেয়গিরির কিনারায় দাঁড়িয়ে দুই দেশ। এক ঝলক উত্তাপেই বিস্ফোরণের অপেক্ষা। এদিন মাঝরাতে সেই ভয়ংকর হামলারই পূর্বাভাসই দিলেন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লা তারার। জানালেন, আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সামরিক আক্রমণ করতে পারে ভারত। এ বিষয়ে তাদের কাছে নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য আছে বলে দাবি করেছেন তিনি। ওইদিন সন্ধ্যায় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে তিন বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে পালটা হামলার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার প্রেক্ষিতেই এমন মন্তব্য করেন আতাউল্লা। মঙ্গলবার রাজধানী ইসলামাবাদে মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারার বলেছেন, নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, পহেলগাঁওয়ের ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে যে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট অভিযোগ ভারত এনেছে, তারই জের ধরে আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে দেশটি। তিনি আরও বলেছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত স্পষ্টতই অযৌক্তিক ও সংঘাতের বিপজ্জনক পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার পরিণতি সমগ্র অঞ্চল ও বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক হবে। তবে যে কোনো আগ্রাসনের জবাব পূর্ণশক্তি দিয়েই দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানে আক্রমণ এত সহজ নয় বলে জানিয়েছেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মরিয়ম নওয়াজ। মঙ্গলবার লাহোরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে। কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ আল্লাহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে দেশরক্ষার শক্তি দিয়েছেন। পাকিস্তানে যে কোনো শত্রু আক্রমণ করার আগে ১০ বার ভাববে। সবাই জানে যে পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর।’ একই দিনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সিনেটে বলেছেন, পাকিস্তান প্রথমে ভারতে আক্রমণ করবে না। তবে কোনো আঘাত এলে তার জবাব দেবে। ভারতের বিরুদ্ধে পুরো পাকিস্তান এখন ঐক্যবদ্ধ বলেও জানিয়েছেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগ্রাসী অবস্থান পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই নেতা ইমরান খান।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছেন তার মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক। তিনি বলেছেন, মঙ্গলবার গুতেরেস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্করের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছেন। উত্তেজনা কমানোর প্রচেষ্টা হিসাবে তিনি তার পক্ষ থেকে সৌহার্দপূর্ণ মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে এ ফোনকলে শাহবাজ জাতিসংঘ মহাসচিবকে বলেছেন, ভারতকে থামান। নয়াদিল্লিকে দায়িত্বশীল আচরণ ও সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাতে গুতেরেসকে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। এদিকে ভারত ও পাকিস্তানকে উত্তেজনা না বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এই দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে শিগগিরই কথা বলবেন বলে জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। উত্তেজনার মধ্যেই ভারতের মন্ত্রিসভা নিরাপত্তা কমিটি (সিসিএস), অর্থনৈতিক (সিসিইএ) ও রাজনৈতিক (সিসিপিএ) বিষয়ক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনীকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দেওয়ার পরদিন বুধবার এ বৈঠক করেন তিনি। যেখানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডে (এনএসবি) আমূল পরিবর্তন আনেন মোদি। নতুন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) সাবেক প্রধান অলোক যোশি। এছাড়া, সাবেক সেনা ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তাসহ সাত সদস্যের একটি শক্তিশালী দল গঠন করা হয়েছে। যারা প্রতিরক্ষা, পুলিশ ও কূটনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে নিরাপত্তা কৌশল পুনর্গঠন করবেন।