
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) আওয়ামীপন্থী দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর আগে গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর শিক্ষার্থীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এদিকে, ৫ আগস্টের পর থেকে অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান চাঁন ও অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমান লিটু নামে এই দুই শিক্ষককে ইনস্টিটিউটের সব ধরনের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
দুই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে স্বৈরাচার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিরোধিতা, রাজনৈতিক পেশিশক্তি খাটিয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক নিপীড়ন ও ধর্মীয় পোশাকের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের হেনস্তা এবং অকৃতকার্য করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাদের স্থায়ী অব্যাহতির দাবি অনড় রয়েছেন ইনস্টিটিউটটির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।
ড. মাহবুবুর রহমান লিটুর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে অসদাচরণ, ক্লাস এবং পরীক্ষায় অনিয়ম, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতাবিহীন স্বেচ্ছাচারিতা, অনির্বাচিতভাবে বোর্ড অব গভর্নেন্স এর সদস্যপদে বহাল থাকা, ভাইভা বোর্ডে শিক্ষার্থীর সাথে অসদাচরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর একাডেমিক ক্ষতিসাধন, শিক্ষক নিয়োগে সরাসরি যুক্ত থেকে সরকারদলীয় অযোগ্য রাজনৈতিক প্রার্থীদের পক্ষপাতদুষ্টভাবে পদায়ন, অশিক্ষকসুলভ এবং অশোভন (মদ্যপ) আচরণ করেন।
তাছাড়া সহকারী প্রক্টর থাকা অবস্থায় বেআইনিভাবে শিক্ষার্থীদের দমন পীড়ন, এমনকি মৌখিক ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা, হেনস্তা এবং অপদন্তকরা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হুমকি ও অশালীন আক্রমণাত্মক বাক্য ব্যবহার, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনা অনুমতি নজরদারি এবং বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা, অন্য ডিসিপ্লিনের গবেষকদের বিভিন্ন গবেষণাপত্র অনৈতিকভাবে ও চৌর্যবৃত্তির সাহায্যে নিজের প্রোফাইলে যুক্ত করাসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে ড. মাহবুবুর রহমান লিটুর বিরুদ্ধে।
এছাড়াও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত আক্রমণ, অপ্রীতিকর ভাষা ব্যবহার, বিভিন্ন সময়ে তাকে শিডিউল ক্লাসের পরিবর্তে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজকে অধিক মূল্য দেওয়া (যেমন- ক্লাসের সময় টিভি চ্যানেলে ইন্টারভিউ দেয়া), এক ছাত্রীকে পর্যাপ্ত কারণ দর্শানোর সুযোগ না দিয়ে অকৃতকার্য ঘোষণা করা, পরীক্ষার মূল্যায়নে জবাবদিহিতাবিহীন স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উঠে এসেছে।
গত ৫ আগস্টের পর এসব অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে মাসব্যাপী আন্দোলন করেন ইনস্টিটিউটটির শিক্ষার্থীরা। পরে তদন্ত করতে তিনিসহ অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান চাঁনের বিষয়ে একটি ৬ সদস্য বিশিষ্ট 'তথ্যানুসন্ধান কমিটি' গঠন করা হয়েছে এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলাকালীন সময়ে তাদের প্রশাসনিক ও একাডেমিক দায়িত্ব সমূহ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল।
তথ্যানুসন্ধান কমিটি সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামীপন্থী দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অর্ধশতের বেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অভিযোগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান লিটুর বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ করেছেন, তিনি মদ্যপ অবস্থায় বিভিন্ন সময় ক্লাসে যেতেন। শুধু তাই নয়, মদ্যপ অবস্থায় তিনি ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অশালীন কথাবার্তাও বলতেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তথ্যানুসন্ধান কমিটি এক সদস্য দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইনস্টিটিউটের ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী-শিক্ষক অভিযোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান লিটুর বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ করেছেন, তিনি মদ খেয়ে ক্লাসে যেতেন এবং ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতেন। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে কমিটি কাজ করছে বলে তিনি জানান।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান লিটুর রুমে সবসময় মাদক থাকত। তিনি ক্লাসে এসে আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন। রাজনৈতিক পেশিশক্তি প্রভাব দেখিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এসব করতেন।
মদ্যপ অবস্থায় ক্লাসে যাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে ড. মাহবুবুর রহমান লিটু দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এ অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যে ও অপপ্রচার। শিক্ষক হিসেবে এটা আমার জন্য দুর্ভাগ্যজনক একটি বিষয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের পাশে তিনি ছিলেন বলে এসময় তিনি দাবি করেন।
নানা অভিযোগে অভিযুক্ত আওয়ামীপন্থী এরকম একাধিক শিক্ষকের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের সময়ের শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ আছে। সরাসরি প্রমাণ দিয়ে তারা অভিযোগগুলো করেছেন। এজন্য আমরা প্রাথমিকভাবে পাঁচ স্তর বিশিষ্ট পদ্ধতি ফলো করছি। প্রথমত এই ধরনের অভিযোগগুলো নিয়েছি। আমলে নেওয়া যায় কী না আইন বিভাগের সহকর্মীদের প্রাথমিক মূল্যায়ন করবে। তারপর বিভাগের সাহায্যের মাধ্যমে প্রথমে চেষ্টা করি। তারপর আমরা সত্যানুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে আমলে নেওয়ার সুযোগ আছে, তার ভিত্তিতে আমরা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি করে দেয়। সেখানে কয়েকজন প্রতিনিধি থাকেন। তখন আত্মপক্ষের সুযোগ দিয়ে যিনি অভিযোগ করেছেন এবং যিনি অভিযুক্ত তাদের প্রতিনিধির সাথে কথা বলে প্রক্রিয়াটা এগিয়ে যায়। এটিকে ইতিবাচক কিছু করা যায় কিনা সেটাও আলোচনা করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে যদি কাজ না হয় তাহলে আইনগতভাবে আরো গভীরে যাওয়ার সুযোগ আছে। এটা সিন্ডিকেট যাবে, সিন্ডিকেটের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি হবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী ট্রাইবুনাল গঠন, তদন্ত কমিটি হবে এবং সবশেষ অভিযোগকারীর পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি নিয়ে ট্রাইবুনাল গঠন হবে। এই সিন্ডিকেট পর্যন্ত আটটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমাদের যেতে হবে। যদি অনুসরণ না করি তাহলে যেকোনো সময় আমরা মামলাতে হেরে যাবো।’
‘‘এজন্যই আইন মেনে চলা জরুরি এবং আমরা একটি আইনজ্ঞ কমিটি গঠন করে দিয়েছি আইনগত পরামর্শ দেওয়ার জন্য৷ এতে দুইজন ব্যারিস্টার ও আইন বিভাগের শিক্ষকরা রয়েছেন। ইতোমধ্যে তিন চারটি কমিটির রিপোর্ট চলে এসেছে এবং ধীরে ধীরে আমরা তা সিন্ডিকেটে নিয়ে যাচ্ছি। এসব সিদ্ধান্তে আবেগ তাড়িত হওয়ার সুযোগ নেই। তাই আমাদের সময় লাগেছে।’’