
মুলসুমা আক্তার লাকি। স্বামী ও একমাত্র সন্তানকে নিয়ে ছিল তার সংসার। ছয় বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন ইমনকে। ছিল ভিটে-বাড়িহীন অভাবের সংসার। ভাগ্য পরিবর্তনে দু’জনে কিশোরগঞ্জ থেকে চলে আসেন ঢাকায়। পোশাক কারখানায় তারা চাকরি নেন। তাদের কোলজুড়ে আসে এক ছেলে সন্তান। ভাগ্যের চাকা কিছুটা পরিবর্তন হলেও হঠাৎ মুলসুমার সুখের সংসারে নেমে আসে বিষাদের কালো মেঘ। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে গুলিতে কেড়ে নেয় তার স্বামীর জীবন। স্বামীকে হারিয়ে ভেঙে পড়েন তিনি। ইমন যখন মারা যান তখন মুলসুমা সন্তানসম্ভবা ছিলেন। গত মার্চ মাসে তার কোল জুড়ে আসে এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান। অভাব-অনটনের সংসারে দুই মাসের শিশু সন্তানকে রেখে তিনি আবার যোগ দেন কাজে। দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। গণ-অভ্যুত্থানের পরে পাননি সরকারি-বেসরকারিভাবে যথাযথ সহযোগিতা ও ক্ষতিপূরণ। স্বামীকে হারিয়ে জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত করছেন যুদ্ধ।
মুলসুমা মানবজমিনকে বলেন, অনেক কষ্টে জীবন চালাতে হচ্ছে। আমার দুই সন্তান নিয়ে কোথায় থাকবো? কীভাবে পড়াশোনা করাবো সন্তানদের। এসব চিন্তায় দিশাহারা হয়ে পড়ছি। কী হবে আমার দুই সন্তানের ভবিষ্যত? আমার স্বামী ১৯শে জুলাই বিকালের দিকে গুলিতে মারা যান। ৮ই মার্চ আমার কন্যাসন্তান হয়। আমার পাঁচ বছরের আরেকটি ছেলে সন্তান রয়েছে। সংসার চালাতে না পেরে দুই সন্তানকে রেখে আবার পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছি। আমাদের কেউ কোনো খোঁজখবর রাখেনি। সরকারি-বেসরকারিভাবে অল্প কিছু সহযোগিতা পেয়েছি। কাগজপত্র অনেক জায়গায় জমা দিয়েছি। যে টাকা পেয়েছি সে টাকা দিয়ে এতদিন চলেছি। বর্তমানে অনেক ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর কিশোরগঞ্জে চলে গিয়েছিলাম কিন্তু সেখানেও ভিটেবাড়ি নেই। আমার শ্বশুর অনেক আগে মারা যান। শাশুড়ি মাটি কাটার কাজ করতেন এখন কিছু করতে পারেন না। ১৩ হাজার টাকা বেতন পাই এখানে। বাসা ভাড়া দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। আমি না খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু ছোট সন্তান ও বয়স্ক মানুষকে তো না খাইয়ে রাখতে পারি না। ভেবেছিলাম দু’জনে কাজ করে একটু ভিটেবাড়ি করবো কিন্তু স্বপ্ন দেখার আগেই আমার স্বপ্ন শেষ। মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়ে আমাকে ছাড়া তবুও চাকরি করতে হচ্ছে। ছেলেটাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলাম কিন্তু এখন আর পাঠাতে পারি না সেখানে। একদিকে আর্থিক সমস্যা অন্য দিকে আমি বাসায় না থাকলে তাকে কে দেখবে।
তিনি বলেন, বাড়িঘর না থাকায় গ্রামেও যেতে পারছি না। ঘরে ঠিকমতো খাবার কিনতে পারি না। ছেলেটাকে ওর বাবা অনেক ভালোবাসতো। ছেলেও বাবাকে ছাড়া থাকতে পারে না। ঈদের সময় ছেলেটা বাবার জন্য অনেক কান্নাকাটি করেছে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট মেয়েটাকে দেখে যেতে পারলো না। তার মেয়ে সন্তানের অনেক শখ ছিল। ঘটনার দিন ঘরে বাজার না থাকায় কারখানায় গিয়েছিল টাকা আনতে। সেখান থেকে ফেরার পথে গুলি লাগে বুকের বাম দিকে। সেদিন সন্ধ্যার দিকে এক অপরিচিত লোকের মাধ্যমে খবর পাই আমি।
শুধু পোশাক শ্রমিক ইমন নয়, জুলাই আন্দোলনে অসংখ্য শ্রমিকদের ছিল সাহসী ভূমিকা। অনেকে দিয়েছেন জীবন। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এভাবে প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধ করে যাচ্ছেন অসংখ্য শহীদ পরিবার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে কেউ হারিয়েছেন সন্তান, কেউ স্বামী, কেউ ভাই, কেউবা বাবা-মাকে। তাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে প্রিয়জন হারানোর কষ্টে। অনেকে পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে নিহত পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী আবদুল গণি। তিনি গুলশান-২ এ একটি আবাসিক হোটেলের কর্মচারী ছিলেন। ১৯শে জুলাই কর্মস্থলে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। নিহতের স্ত্রী লাকি আক্তার মানবজমিনকে বলেন, আমার স্বামী ছিল সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। তার মৃত্যুতে আমরা ভেঙে পড়েছি। সন্তানদের কোনো চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। সন্তানদের লেখাপড়া ঠিকমতো হচ্ছে না। এদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে কীভাবে আমি তৈরি করে দিবো সেই চিন্তাই কাটছে না। আমরা এখন গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীতে থাকি। এরআগে ১৪ বছর ধরে ঢাকায় ছিলাম। খুব ভালো চলছিল সন্তানদের নিয়ে। এখন অবস্থা খুবই খারাপ। আমার ছেলে গত বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল তখন দুই সাবজেক্টে ফলাফল খারাপ এসেছিল। এইবার আবার পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল কিন্তু ওর বাবা মারা যাওয়ার পর আর পরীক্ষা দিতে পারেনি। ওর বাবা যে হোটেলে কাজ করতো সেই হোটেলে সে এখন কাজ করে। খুব অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরার জন্য পড়াশোনা বাদ দিয়ে ছেলেটি কাজ শুরু করেছে। আমি এসএসসি পাস করেছিলাম। অল্প কিছু সহযোগিতা পেয়েছিলাম সেইটা দিয়ে কোনোমতে চলছি। তিনি বলেন, স্বপ্ন ছিল সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করবো। একটা সুখের সংসার হবে আমাদের কিন্তু সেটি আর পূরণ হলো না।
রাসেল মিয়া (২২)। ভ্যানগাড়িতে মালামাল বিক্রি করতেন। রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বোনের সঙ্গে বসবাস করতেন। রাসেলের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি। গত ১৯শে জুলাই শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চালাকালীন জুমার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এলোপাতাড়ি গুলির মুখে পড়েন। এ সময় একটি গুলি রাসেলের গলার এক পাশে বিদ্ধ হয়ে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। রাসেলের মা মাকসুদা বেগম বলেন, আমার সন্তান তো নেই আর, তাকে তো গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি তো শেষ হয়ে গেছি। আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। রাসেল ছিল সবার ছোট। সে তার বোনের কাছে থাকতো। আমরা ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় থাকি। গ্রামে কোনো সম্পদ নেই। আমার রাসেল মাসে কিছু টাকা দিতো আমাদের ও নিজে চলতো। আমার সন্তানের মুখটা তো কিছুতেই ভুলতে পারছি না