
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীন বিভিন্ন প্রকল্পে বিদ্যুতের খুঁটি (খাম্বা) সরবরাহের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল চার প্রতিষ্ঠানের হাতে। প্রতিষ্ঠানগুলো তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের (বিপু) ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচতি। এই চার প্রতিষ্ঠান হলো জেমকন গ্রুপ, কনটেক কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, টিএসসিও পাওয়ার লিমিটেড এবং গ্লোরি পোল।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিষ্ঠান চারটির বাইরে অন্য কেউ পল্লী বিদ্যুতের দরপত্রে অংশ নিতেও ‘ভয়’ পেত। অংশ নিলেও কাজ পেত সামান্যই। খুঁটি কেনায় এই সিন্ডিকেট বা চক্রের বিষয়টি ধরা পড়েছিল সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি দেখভালের দায়িত্বে থাকা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) হাতে। তবে তৎকালীন সরকারের শীর্ষ মহলের আশীর্বাদে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ভবিষ্যতে আরইবির খুঁটি সরবরাহ প্রকল্পে এমনভাবে দরপত্র আহ্বান করা হবে, যাতে যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে অংশ নিতে পারে। এটি নিশ্চিত করা গেলে কোনো ঠিকাদারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।ফাওজুল কবির খান, জ্বালানি উপদেষ্টা
আরইবি থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল—এই চার বছরে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১৮ লাখ ৮১ হাজারটি বিদ্যুতের খুঁটি কেনা হয়েছে। এতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। এর ৫৬ শতাংশ কাজ পেয়েছে ওই চার প্রতিষ্ঠান। বাকি ৪৪ শতাংশ কাজ পায় বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিসহ খুঁটি প্রস্তুতকারী ১৮টি প্রতিষ্ঠান।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, যশোর-৩ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের প্রতিষ্ঠান জেমকন গ্রুপ ওই চার বছরে খুঁটি সরবরাহে ৯০১ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে; যা মোট ব্যয়ের ১৭ ভাগ। তাঁরা প্রায় তিন লাখ খুঁটি সরবরাহ করেছে। কাজী নাবিল ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন। এ কারণে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
খুঁটি সরবরাহে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কাজ পেয়েছে কনটেক কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেয়েছে ৮৪৮ কোটি টাকার; যা মোট ব্যয়ের ১৬ ভাগ। চার বছরে তারা ১ লাখ ৫১ হাজার খুঁটি সরবরাহ করেছে। এ প্রতিষ্ঠানের মালিক সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্সের (এসবিএসি) চেয়ারম্যান মোখলেসুর রহমান। তিনি কনটেক কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের চেয়ারম্যানও।
এ বিষয়ে মোখলেসুর রহমান ২৩ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, এটি তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা। আরইবির উন্মুক্ত দরপত্র–পদ্ধতিতে (ওটিএম) অংশ নিয়ে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তাঁরা কাজ পেয়েছেন। রাজনৈতিক প্রভাব থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিষ্ঠান চারটির বাইরে অন্য কেউ পল্লী বিদ্যুতের দরপত্রে অংশ নিতেও ‘ভয়’ পেত। অংশ নিলেও কাজ পেত সামান্যই।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা টিএসসিও পাওয়ার লিমিটেড ৬৮৯ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে, যা মোট ব্যয়ের ১৩ ভাগ। তারা খুঁটি সরবরাহ করেছে ১ লাখ ২৮ হাজারটি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কুমিল্লা-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন শামীম। অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির এমডি পদে পরিবর্তন আসছে। নতুন দায়িত্ব পাচ্ছেন ব্যারিস্টার মোহাম্মদ ইফতেখার জুনায়েদ। তিনি সাবেক গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর ছেলে।
আর চতুর্থ অবস্থানে থাকা গ্লোরি পোল ৫৩০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে, যা মোট ব্যয়ের ১০ ভাগ। তারা ১ লাখ ৪০ হাজার খুঁটি সরবরাহ করেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিষ্ঠান চারটি এত বেশি কাজ পেয়েছে যে সঠিক সময়ে খুঁটি সরবরাহ করতে পারেনি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা দাম নিয়ন্ত্রণ করত। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে টিএসসিও পাওয়ার লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নাফিজা ইসলাম ২০ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, খাম্বা কেনার সব কটিই উন্মুক্ত দরপত্র। সেখানে সর্বনিম্ন দরদাতা টিএসসিও যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ পেয়েছে। কোনো রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়নি দাবি করে নাফিজা ইসলাম বলেন, কেউ কাজ না পেলে অপপ্রচার চালায়। এখানেও তা-ই হচ্ছে।
আরইবি থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল—এই চার বছরে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১৮ লাখ ৮১ হাজারটি বিদ্যুতের খুঁটি কেনা হয়েছে। এতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। এর ৫৬ শতাংশ কাজ পেয়েছে ওই চার প্রতিষ্ঠান।
আরইবির বিদ্যুতের খুঁটি সরবরাহের অসংগতি নিয়ে প্রথম আলোতে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি কেনায় চক্রের বিষয়টি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিপিটিইউতে ধরা পড়েছিল। কয়েক বছর আগে সংস্থাটির এক পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি কেনায় চক্র কাজ করছে। উদাহরণ দিয়ে সিপিটিইউ বলেছিল, পল্লী বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থার (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট) ক্ষমতাবর্ধন প্রকল্পের একটি চক্র কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে দরপত্র জমা দেয়। পরে তারা কাজ পায়।
আরইবির প্রধান প্রকৌশলী (প্রকল্প) আবদুর রহিম মল্লিক ২০ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, একচেটিয়া কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে কাজ না পায়, তাঁরা সেদিকে নজর রাখছেন। এর বেশি কিছু মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিষ্ঠান চারটি এত বেশি কাজ পেয়েছে যে সঠিক সময়ে খুঁটি সরবরাহ করতে পারেনি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা দাম নিয়ন্ত্রণ করত। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
প্রিপেইড মিটার–ট্রান্সফরমার কেনায়ও ‘চক্র’
আরইবির বিদ্যুতের খুঁটির মতো প্রিপেইড মিটার–বাণিজ্যেও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ‘ভাই-বন্ধু’ নামে পরিচিত কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। সেগুলো হচ্ছে হেক্সিং, ইনহে মিটার, শেনজেন স্টার, ওয়াসিওন ও হোলি মিটার। তাদের বাইরে অন্য কেউ প্রিপেইড মিটার সরবরাহে দরপত্রে অংশ নিতে পারত না। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটি নসরুল হামিদের ‘ভাই-বন্ধু’দের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।
আরইবিতে ট্রান্সফরমার কেনায়ও ‘সিন্ডিকেট’ আছে। ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল—এই ১০ বছরে ট্রান্সফরমার কেনায় নিয়ন্ত্রণ ছিল মোটাদাগে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। একটি টিএস ট্রান্সফরমার লিমিটেড, অন্যটি ভিকার ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেড। ভিকার ইলেকট্রিক্যালের মালিকপক্ষে রয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎমন্ত্রী এনামুল হকের ভাই নাজমুল হক এবং এসকিউ গ্রুপের এমডি কুমিল্লা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন শামীমের ছোট ভাই সোহেল আহমেদ। টিএস ট্রান্সফরমার এবং ভিকার ইলেকট্রিক্যাল আসলে এসকিউ গ্রুপের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান।
গত ১০ বছরে দুই হাজার কোটি টাকার ট্রান্সফরমার কিনেছে আরইবি। যার ৬১ শতাংশ কাজ পেয়েছে টিএস ট্রান্সফরমার ও ভিকার ইলেকট্রিক্যাল। ৭০১ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে টিএস ট্রান্সফরমার। অন্যদিকে ভিকার ইলেকট্রিক্যাল পেয়েছে ৫১২ কোটি টাকার কাজ।
আরইবিতে ট্রান্সফরমার কেনায়ও ‘সিন্ডিকেট’ আছে। ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল—এই ১০ বছরে ট্রান্সফরমার কেনায় নিয়ন্ত্রণ ছিল মোটাদাগে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। একটি টিএস ট্রান্সফরমার লিমিটেড, অন্যটি ভিকার ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেড।
আগের কাজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে
বর্তমানে আরইবির গ্রাহকসংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তিনটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এতে মোট ব্যয় হচ্ছে ১১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলো হলো ৩ হাজার ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা বিভাগের বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থার আধুনিকায়ন, ৭ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং ১ হাজার ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে বরিশাল বিভাগের বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থার আধুনিকায়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পেও খুঁটি কেনা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুঁটির অন্তত ২২টি কারখানা রয়েছে। প্রতিটি খুঁটির দাম এখন প্রায় ২৯ হাজার টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ১৬ হাজার টাকা। এতে বোঝা যায়, খুঁটির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ২৩ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, পল্লী বিদ্যুতে বিগত সময়ে খুঁটি সরবরাহের কাজ কারা কারা পেয়েছে, সেটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সে সময়ে তৈরি করা দরপত্রে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, তা দেখা হচ্ছে। এই উপদেষ্টা আরও বলেন, ভবিষ্যতে আরইবির খুঁটি সরবরাহ প্রকল্পে এমনভাবে দরপত্র আহ্বান করা হবে, যাতে যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে অংশ নিতে পারে। এটি নিশ্চিত করা গেলে কোনো ঠিকাদারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।