
ফিক্সড ডিপোজিটের নামে গ্রাহকদের তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ঢাকার দোহারের জয়পাড়া শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ভুয়া রসিদ প্রদান করে ওই ব্যাংকেরই গ্রাহক আলাউদ্দিন মোল্লার ৯০ লাখ টাকা, আবুল হোসেনের ২০ লাখ, মাহমুদা আক্তার লাকীর ৩০ লাখ ও তার স্বামী বোরহানুল হকের ৩০ লাখ, জামাল আহম্মেদের ১৫ লাখ, রোকছানা আক্তারের ৪৫ লাখ এবং ফাতেমা আক্তারের দু’টি ডিপোজিট থেকে ৩২ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছে ব্যাংক ম্যানেজার শহিদুল। এ ঘটনায় সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে এর প্রতিকার চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা।
জানা যায়, গেল কয়েক মাস ধরেই পলাতক রয়েছেন সাবেক ব্যাংক ম্যানেজার শহিদুল। এ ঘটনায় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক জয়পাড়া শাখার ফাস্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার আব্দুল রাকিব তালুকদার সাবেক ম্যানেজার শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে দোহার থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন। বর্তমান মামলাটি দুদক, ঢাকা-২ তদন্ত করছেন বলে জানা যায়। জয়পাড়ার শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক শহিদুল ব্যাংকের ভেতর তার নিজের কক্ষে বসে করা এমন প্রতারণায় হতবাক ব্যাংক সেক্টরে দীর্ঘসময় ধরে লেনদেন করা ঠিকাদার ও দোহার উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মোল্লা। তিনি জানান, চলতি বছরের ৩রা ফেব্রুয়ারি তার মালিকানাধীন মেসার্স লাকী এন্টারপ্রাইজের পুরাতন একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট (হিসাব নং- ৪০১৪১১১০০০০৩৪৪০) সম্পর্কে খোঁজ নিতে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক জয়পাড়া শাখায় গেলে তৎকালীন ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম তাকে জানান অ্যাকাউন্টটি বন্ধ রয়েছে। তবে ২ হাজার টাকা জমা দিলে একাউন্টটি সচল হবে এমন কথা শুনে তিনি টাকা জমা দিয়ে অ্যাকাউন্টটি চালু করেন। একই তারিখে তিনি ম্যানেজারের রুমে বসে সরল বিশ্বাসে মেসার্স লাকী এন্টারপ্রাইজের সেই অ্যাকাউন্টে নগদ ৫ লাখ ও সোনালী ব্যাংক জয়পাড়া শাখার একটি ৮৭ লাখ টাকার চেক জমা করেন। এ সময় ম্যানেজার তাকে মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিট (এমটিডিআর) সম্পর্কে প্রলুব্ধ করলে ৫ই ফেব্রুয়ারি পুনরায় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক জয়পাড়া শাখায় গিয়ে ম্যানেজারের রুমে বসে তার হাতে মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিট (এমটিডিআর) করার জন্য ৯০ লাখ টাকার মেসার্স লাকী এন্টারপ্রাইজের একটি চেক দেন। এর কিছুক্ষণ পর তৎকালীন ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম তাকে মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিট (এমটিডিআর)-এর প্রমাণস্বরূপ ৯০ লাখ টাকার একটি রশিদও দেন। প্রায় ১ মাস পর ২রা মার্চ তিনি আবারো শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক জয়পাড়া শাখায় গিয়ে আরও ১০ লাখ টাকাসহ মোট ১ কোটি নতুন মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিট করার আবেদন করলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ৫ দিন সময় নেন। পরবর্তীতে ওই শাখার নতুন ম্যানেজার তাকে একটি চিঠি ইস্যু করেন যে, তার মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিটটি (SJIBL/MTDR No-০৬০২৮০৬, তাং- ০৫/০২/২০২৫) যথাযথ কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে ইস্যু করেননি অর্থাৎ উক্ত রিসিটটি জাল। এ কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে যাই।
আলাউদ্দিন মোল্লা আরও বলেন, আমি নতুন ম্যানেজারকে অবহিত করি, শাখায় সাবেক ম্যানেজার শহিদুল ইসলামের হাতে আমি চেক ও নগদ দিয়ে দিয়েছিলাম। ব্যাংক ম্যানেজার জালিয়াতি করলে তার দায়ভার ব্যাংককে নিতে হবে। কিন্তু জয়পাড়া শাখা কর্তৃপক্ষ আমার কোনো কথায় কর্ণপাত করেনি।
কষ্টার্জিত টাকা না পেলে আত্মহত্যা করবে বলে জানান প্রতারণার শিকার আরেক ভুক্তভোগী মাহমুদা আক্তার লাকী। স্বামী-স্ত্রীর দীর্ঘদিনের প্রবাস জীবনের অর্জিত সব অর্থ হারিয়ে নিঃস্ব এ দম্পত্তি। তিনি বলেন, আমাদের প্রায় ৬০ লাখ টাকা আত্মসাত করেছে সাবেক ম্যানেজার শহিদুল। স্বপ্ন ছিল ছেলেকে অস্ট্রেলিয়া পাঠাবো, সেই স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। প্রতি মাসে আমার ও আমার স্বামীর ২০ হাজার টাকার ওষুধ লাগে, টাকার অভাবে এখন তাও কিনতে পারছি না। আমরা সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে গেছি। টাকাগুলো ফেরত না পেলে আত্মহত্যা ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ থাকবে না। এ সময় তিনি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
প্রতারণার শিকার জামাল আহমেদ বলেন, ব্যাংক ম্যানেজার আমাদের অধিক লাভের আশা দেখিয়েছিলেন। ভাবতে পারি নাই, সে এভাবে প্রতারণা করবে। কষ্ট করে জামানো ১৫ লাখ টাকা নিয়ে ব্যাংক ম্যানেজার লাপাত্তা। আমরা তো ম্যানেজারকে টাকা দেই না, শাহজালাল ব্যাংককে বিশ্বাস করে টাকাগুলো রেখেছিলাম। ব্যাংকে বসে ম্যানেজার দুর্নীতি করলে তার দায় ব্যাংককেই নিতে হবে। কিন্তু জয়পাড়া শাখার বর্তমান ম্যানেজার আমাদের কোনো সহযোগিতা করছেন না।
ব্যাংকের রশিদ জাল করে ব্যাংকে বসে জালিয়াতির এ কৌশলে হতভম্ব গ্রাহকরা। এদিকে ভুয়া রশিদ বানিয়ে গ্রাহকের তিন কোটি টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যাংক ম্যানেজার লাপাত্তা হওয়ার ঘটনায় শঙ্কিত এখন সাধারণ মানুষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক ব্যাংকের ম্যানেজার জানান, এমন ঘটনার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের। শাহজালাল ব্যাংক ম্যানেজারের এমন কর্মকাণ্ডের কারণে দোহারে ২২টি ব্যাংকের শাখা ও ৬টি উপশাখায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে জানান তারা। এ ব্যাপারে শাহজালাল ব্যাংক জয়পাড়া শাখায় গেলে বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত শাখা ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি ব্যাংকের জনসংযোগ শাখায় যোগাযোগ করতে বলেন।