
চলে গেল দাউদ। বলছি- কবি-সাহিত্যিক দাউদ হায়দারের কথা। আমার ৫৪ বছরের বন্ধু। প্রায় কাছাকাছি সময়ে সাংবাদিকতায় এসেছিলাম। পাতা উল্টালে জন্ম তারিখও দূরে নয়। দাউদ সংবাদে, আমি বাংলার বাণী হয়ে পূর্বদেশে। দাউদ মারা গেল প্রবাসে। ইচ্ছা ছিল বাকি জীবনটা দেশে কাটাতে। তার শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। রাষ্ট্র নামক যন্ত্র তাকে সে সুযোগ দেয়নি। একটি কবিতার জন্য ৫১ বছর নির্বাসনে। এটা বোধ করি ইতিহাসে বিরল। একটি কবিতা লিখেছিল দৈনিক সংবাদে। ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। বঙ্গবন্ধুর প্রশাসন ঝুঁকি না নিয়ে তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। তের বছর কেটেছে ভারতে। বাকি জীবন জার্মানিতে। কবি হিসেবে তার নাম-ডাক ছিল। আড্ডাবাজ দাউদ কথা বলতো জমিয়ে। কখনো কারও মুখের দিকে তাকিয়ে নয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! নীরবে-নিভৃতে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেল। দাউদ আমার পরম বন্ধু।
প্রেস ক্লাবের আড্ডায় মাঝেমধ্যেই মতপার্থক্য প্রকট হতো। কিন্তু ঝগড়ায় রূপ নেয়নি কখনো। তার সঙ্গে আসলেই আমার মতের কোনো মিল ছিল না। বিস্তর ফারাক ছিল তার নীতি-আদর্শের প্রতি। ধর্ম নিয়ে লেখার কারণেই নির্বাসনে যেতে হয়েছিল তাকে। বিশ্বাস করুন, কোনোদিন কোনো আড্ডায় তার সঙ্গে ধর্ম নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। এটা তার ব্যক্তিগত মত। সংবাদ কর্তৃপক্ষ কবিতাটি প্রত্যাহার করেছিলেন। সে নিজেও দুঃখ প্রকাশ করেছিল। ৫১ বছরে বাংলাদেশে অনেক সরকার এসেছে। পরিণতি সবার জানা। দাউদ যখন দেশ ছাড়ে তখন ছিল তার পছন্দের সরকার। মাঝখানে বৈরী। এরপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন সরকার এলো তখন একদিন ফোন করে বললো, এবার মনে হয় আমার দেশে ফেরা হবে। কিন্তু এবারো নিয়তি তার পক্ষে নয়। হাসিনার সরকার তাকে জানিয়ে দিলো-ফেরানো সম্ভব নয়। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল দাউদ। বলেছিল, আসলে ওদের চরিত্র একই। কলকাতা থাকাকালীন তিনবার তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাসায়। তখন আমি কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় কাজ করতাম। অন্নদাশঙ্কর ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক। দাউদকে পছন্দ করতেন। ছেলের মতো দেখতেন।
একদিন আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি পরিতোষ পালকে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাসায় আড্ডায় যোগ দিয়েছিলাম। সে আড্ডায় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন। বাইরে থেকে শুধু দাউদের কণ্ঠই শুনছিলাম। যেকোনো আড্ডা সে মাতিয়ে রাখতো। বার্লিনেও দেখা হয়েছে তিনবার। বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করতে গিয়েছিলাম জার্মানিতে। খবর পেয়ে আগেই বলে রেখেছিল- এবার কিন্তু আমার বাসায় আসবি। আমার হাতেগোনা তিন-চারটা বন্ধু আছে যাদের সঙ্গে তুই-তুই সম্পর্ক। দাউদ এর মধ্যে অন্যতম। কৌতূহল থাকবে বাকিরা কারা। শফিক করিম সাবু, আশরাফ খান ও কলকাতার জয়ন্ত চক্রবর্তী। আমি অনেকের সঙ্গেই তুমি বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। এ নিয়ে আমার স্ত্রী সবসময় বলে, তোমার ছেলের সমান বয়স যাদের তাদেরকেও আপনি বলো কেন? এই প্রশ্নে আমার জবাব নেই। যাই হোক, দাউদের বাসায় যেতে হলো। নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছিল। গল্প করতে করতেই রাত বাজে ৪টা। পরদিন আর্জেন্টিনার খেলা। কী আর করবো। হোটেলে ফিরলাম না। রাতটা কাটিয়ে দিলাম ওর বাসায়।
আরেকবার দেখা হলো প্রফেসর ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা সম্মেলনে। সেবার সে আমার হোটেলে এসেছিল। একসঙ্গে খেয়েছিলাম বাইরে। আরেকবার দেখা হয় ডয়চে ভেলেতে। সে তখন ডয়চে ভেলেতে কাজ করে। তাকে নিয়ে কতো কিছুই না লেখা যায়! চার/পাঁচ বছর আগে এক সন্ধ্যায় অফিসে বসে আছি। এমন সময় চলিশোর্ধ্ব এক মহিলা এসে হাজির। পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি শুনেছি দাউদ হায়দার আপনার বন্ধু। জানেন আমি তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোন করলাম। বললাম, এক মহিলা তোকে বিয়ে করতে চান। অট্টহাসি, কতো মেয়েই তো আমাকে বিয়ে করতে চায়। এটা সেরকমই। ভদ্র মহিলাকে বললাম, আপনি দাউদের সঙ্গেই কথা বলুন। সপ্তাহে দাউদের সঙ্গে আমার একদিন-দু’দিন ফোনে কথা হতো। ঈদসংখ্যা এলেই তাকে স্মরণ করতো কাজল ঘোষ। বহু লেখা তার ছাপা হয়েছে আমাদের কাগজে। যখন তার কোনো লেখা ঢাকার কাগজে ছাপা হতো না তখন আমরা ছেপেছি। শুধু বন্ধুত্বের টানে নয়, লেখার মানে। চমৎকার লিখতো সে। ভাষার প্রতি প্রচণ্ড দখল ছিল। হাসপাতালে অনেকদিন নির্বাক ছিল। ভাবা যায় যে মানুষটি যেকোনো আড্ডার মধ্যমণি সে মানুষটি কাউকে কিছু না বলেই চলে গেল! এটাই কি নিয়তি! আমাদের কলকাতার আরেক বন্ধু রুপায়ণ ভট্টাচার্য এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছে- একটি কবিতার জন্য আজীবন নির্বাসনে যায় যে কবি, সার্থক তার কবিজন্ম। আর একটি কবিতা লিখে যে দেখে না জন্মভূমি তার মতো হতভাগ্য কে রয়েছে! কোথায় তার মৃত্যুস্থল বার্লিন, কোথায় জন্মস্থান পাবনার দোহারপাড়া!