
৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় মো. রাফিউল আলম। পরীক্ষা ভালো হওয়ায় বেশ আত্মবিশ্বাসী তিনি। শুরু করেন মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি। কিন্তু ১৫ মাসেও সেই লিখিত পরীক্ষার ফল মেলেনি। এতে হতাশ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করা এ চাকরিপ্রার্থী। এক বিসিএসের আশায় আড়াই বছরের বেশি সময় কাটিয়ে চাকরির বয়সসীমা শেষের দিকে তার। এখন তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় দিন পার করছেন।
রাফিউল জাগো নিউজকে বলেন, ‘যখন ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হয়েছিল, তখন আমার বয়স ছিল ২৯ বছর ৩ মাস। এটাই শেষ বিসিএস ধরে আবেদন করেছিলাম। প্রস্তুতি ভালো থাকায় প্রিলিতে টিকে যাই। লিখিত পরীক্ষাও ভালো দিয়েছি। সেজন্য মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত যেতে পারবো ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু এখন আমার বয়স প্রায় ৩১ বছর ৮ মাস। এ বিসিএসে না টিকলে আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। এটার আশায় অন্য ছোট চাকরিগুলোও করিনি। দিন যত যাচ্ছে, হতাশ হয়ে পড়ছি। কপালে কী আছে, কিছুই বুঝছি না।’
শুধু রাফিউল আলম নন, ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রায় ১৩ হাজার চাকরিপ্রার্থী হতাশ হয়ে পড়েছেন। প্রিলিমিনারি শেষে প্রায় দেড় বছর পার করলেও লিখিত পরীক্ষার ফল পাননি তারা। এরপর মৌখিক পরীক্ষা ও তার ফল তৈরি করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে আরও দেড় বছর লেগে যেতে পারে। ফলে এ বিসিএস শেষ করতে সাড়ে চার বছর কিংবা তারও বেশি সময় লাগতে পারে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি)। এ নিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা বিরাজ করছে।
লিখিত পরীক্ষা দেওয়া চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, দফায় দফায় তারিখ দিয়েও লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে পারছে না পিএসসি। চারটি বিসিএস নিয়ে সময়সূচির জটিলতায় সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে ৪৫তম বিসিএস। তারা দ্রুত এ বিসিএসের লিখিত ফলাফল ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
তবে পরিকল্পনামাফিক ‘কিছুই করতে না পেরে হতাশ’ পিএসসি কর্মকর্তারাও। তারা বলছেন, যে পরিকল্পনা তারা সাজিয়েছিলেন, তাতে দ্রুত বিসিএসের জট কাটানো যেতো। কিন্তু প্রার্থীরা কোনো বিসিএসের পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করলেই আন্দোলনে নামছেন। এতে তাদের সাজানো পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে পড়ছে। এমনটা চলতে থাকলে জট আরও বাড়বে। ৪৫তম বিসিএস শেষ করতে পাঁচ বছরও লেগে যেতে পারে।
প্রিলির ফল প্রকাশে রেকর্ড, লেজেগোবরে লিখিত!
২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। ওই বছর পিএসসি একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছিল। রোডম্যাপ অনুযায়ী—৩৩২ দিনে বিসিএস শেষ করা হবে। রোডম্যাপ অনুযায়ী প্রিলিমিনারি পরীক্ষা গ্রহণ ও কম সময়ে ফল প্রকাশ করে দেখিয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছিল পিএসসি। কিন্তু এরপর সবই এলোমেলো। এক দফা লিখিত পরীক্ষা পেছানো এবং পরীক্ষার পর ফল প্রকাশে দীর্ঘসময় নেওয়ায় সব ভেস্তে গেছে।
পিএসসির তথ্যমতে, আবেদনপ্রক্রিয়া শেষে ২০২৩ সালের ১৯ মে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষা নেওয়ার ১৭ দিনের মধ্যে প্রিলির ফল প্রকাশ করা হয়। এতে পাস করেন ১২ হাজার ৭৮৯ জন প্রার্থী। এরপর একই বছরের ২৭ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষা শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে নিরাপত্তা শঙ্কার কথা জানিয়ে প্রার্থীরা তখন পরীক্ষা পেছানোর দাবি জানান।
প্রার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা পিছিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নেওয়া হয়। ২৩ জানুয়ারি লিখিত পরীক্ষা শুরু হয়। শেষ হয় ৩১ জানুয়ারি। এরপর প্রায় ১৫ মাস পার হলেও ফল প্রকাশ করা হয়নি।
যে কারণে ফল প্রকাশে এত দেরি
৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় সোহরাব হোসাইনের নেতৃত্বে কমিশনের অধীনে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পিএসসিতেও পরিবর্তন আসছে বলে গুঞ্জন শোনা যায়। তাছাড়া বিসিএসের প্রশ্নফাঁস নিয়েও চাঞ্চল্যকর তথ্য ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ রাখে তৎকালীন কমিশন।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় তিন মাস পর চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন সোহরাব হোসাইন। এরপর অন্য সদস্যদের সরিয়ে দেয় সরকার। ৯ অক্টোবর নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৫ জন সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়।
সোহরাব কমিশন থাকাকালে পিএসসি জানিয়েছিল, ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন শেষের দিকে। জুলাই-আগস্টের দিকে ফল প্রকাশ করা হতে পারে। সেভাবে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ওই কমিশনের বিদায়ের পর মোবাশ্বের মোনেমের কমিশন দায়িত্ব নিয়ে ‘অধিকতর স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা বজায় রাখার স্বার্থে’ লিখিত পরীক্ষার সব খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত এ কারণে লিখিত পরীক্ষার ফলপ্রার্থীদের মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
লিখিত পরীক্ষার খাতা এখন কোথায়?
বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার খাতা সাধারণত দুজন পরীক্ষককে নিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। দুজনের দেওয়া নম্বর আবার নিরীক্ষার সময় মিলিয়ে দেখা হয়। সেখানে নম্বরের বেশি পার্থক্য থাকা খাতাগুলো তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায়। তবে ৪৫তম বিসিএসের ক্ষেত্রে সব খাতাই তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেখানে মূল্যায়ন শেষে আরও কিছু প্রক্রিয়ার পর ফলাফল তৈরি করা হবে।
৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার খাতার সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে পরীক্ষা শাখার (ক্যাডার) একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘তৃতীয় পরীক্ষকের কাছ থেকে প্রায় সব খাতা চলে এসেছে। এখন সেগুলো নিরীক্ষার কাজ চলছে। নিরীক্ষা ও আনুষঙ্গিক আরও কিছু কাজ শেষে সব ঠিক থাকলে জুনের শেষ দিকে অথবা জুলাইয়ে ফল প্রকাশ করা সম্ভব হবে।’
যেসব সমস্যায় চাকরিপ্রার্থীরা
৪৫তম বিসিএসে যে ১২ হাজার ৭৮৯ জন প্রার্থী প্রিলিতে উত্তীর্ণ হন, তারা লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। ফল প্রকাশে দেরি হওয়ায় নানামুখী সমস্যায় পড়েছেন তারা। কারও বয়স শেষের দিকে। ফলে তারা বিসিএসের অপেক্ষায় থাকবেন নাকি অন্য চাকরিতে যোগ দেবেন; তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হন আখতারুল ইসলাম তৈয়্যব। তিনি চারটি বিসিএসে অংশ নিয়ে শুধু ৪৫তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন।
আখতারুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘সামনে আর কোনো বিসিএসে আমি আবেদন করতে পারবো না। শুধু ৪৭তম বিসিএসে পরীক্ষা দিতে পারবো। ৪৬তম বিসিএসে আমি প্রিলিতে উত্তীর্ণ হতে পারিনি। ৪৫তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা ভালো দিয়েছি। এটা নিয়ে এখন সব আশা-ভরসা।’
আখতারুল বলেন, ‘দশম গ্রেডের দুটি চাকরি পেয়েছিলাম। অনেক ভেবেচিন্তে সেগুলোতে যোগ দেইনি। কারণ চাকরিতে যোগ দিলে মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারবো না। শুধু বিসিএসের আশায় আছি। বেশি দেরিতে ফলাফল প্রকাশিত হলে মানসিক যে অবস্থা, তা স্বাভাবিক থাকে না। প্রস্তুতি নিতে নিতে আমরা হাফিয়ে উঠেছি। দ্রুত লিখিতের ফলাফল এবং মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হোক।’
লিখিত পরীক্ষা দেওয়া সাবিনা আক্তার বলেন, ‘লিখিত পরীক্ষা দিয়েই ভাইভার পড়াশোনা শুরু করেছি। প্রথমে জোরেশোরে প্রস্তুতি নিই। কিন্তু ফলাফল না পাওয়ায় ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। যত দেরিতে লিখিত পরীক্ষার ফল হবে, ততই লক্ষ্য ধরে এগোনো কঠিন হবে। সেজন্য দ্রুত লিখিতের ফল প্রকাশ এবং ভাইভা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি আমরা।’
জুনের মধ্যে লিখিতের ফল, ডিসেম্বরের মধ্যে ভাইভা শেষ
চাকরিপ্রার্থীদের হতাশা-ক্ষোভের বিষয়টি অবগত বলে জানান পিএসসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা জানি যে, পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় দীর্ঘসময় পার করাটা খুবই অস্বস্তিকর। মানসিক চাপ থাকে। সার্বিক পরিস্থিতির কারণে এমনটা হয়েছে। আমরা দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেছি নভেম্বরে। সেই হিসেবে আমরা কিন্তু বেশি সময় নিচ্ছি না। দ্রুতই ফল প্রকাশ করে ভাইভা নেওয়া হবে।’
কবে নাগাদ ফল প্রকাশ করা হতে পারে এবং ভাইভা শুরু হবে—এমন প্রশ্নে পিএসসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা ৩০ জুনের মধ্যে ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। আর ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বিসিএসের ভাইভা শেষ করা হবে। ২০২৬ সালের প্রথম দিকে ৪৫তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবো বলে আশা করছি।’