
জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন চানখাঁরপুলে গণহত্যার প্রতিবেদন পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন। ২০ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তদন্ত শেষ করে প্রসিকিউশনে রিপোর্ট দাখিল করে। এ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিলের জন্য আগামী ২৫ মে দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। অপর দিকে তদন্ত শেষ বা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে আরো তিনটি মামলার। এগুলো হলো- গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের হওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা, সাভারের আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় মামলা এবং রামপুরায় কার্নিশে ঝুলে থাকা এক ব্যক্তির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় করা মামলা।
এই মামলাগুলোর খসড়া প্রতিবেদন পাওয়ার পর খুব দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হতে পারে বলে প্রসিকিউশন থেকে জানানো হয়েছিল। তিনটি মামলার মধ্যে ছাত্র আন্দোলনের সময় সাভারের আশুলিয়ায় নিহত ছাত্র-জনতার লাশ স্তূপ করে পোড়ানোর মতো মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গত সপ্তাহের শেষ দিকে বা চলতি সপ্তাহের শুরুতে পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গত ২৩ মার্চ এ মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। আর গত ২২ এপ্রিল তিনি জানান, সাভারের আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় মামলার তদন্ত প্রতিবেদন চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে পেতে পারেন বলে জানিয়েছিলেন।
তবে ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটর গতকাল জানিয়েছেন আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় মামলার তদন্ত নতুন দিকে মোড় নেয়ায় চলতি সপ্তাহে প্রতিবেদন দাখিল হচ্ছে না। এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য আরো একমাস সময় নেয়া হবে। এ ছাড়া শেখ হাসিনার মামলা এবং রামপুরা গুলিবর্ষণের ঘটনায় করা মামলার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আরো সময় লাগবে বলে তিনি জানান। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ২২ এপ্রিল বলেছিলেন, সাভারের আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা এবং তাদের লাশ গাড়িতে রেখে আগুন দিয়ে জালিয়ে দেওয়া মামলার তদন্তের চূড়ান্ত কাজগুলো চলছে। আমরা বলেছি যে, আশা করছি এক সপ্তাহের মধ্যে সেটার রিপোর্ট আমাদের হাতে চলে আসবে। এই সপ্তাহের শুরুতে সেটার রিপোর্ট আমরা পাবো। তিনি বলেন, তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর ফরমাল চার্জ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হবে। পরবর্তীতে আইনের যে প্রক্রিয়াগুলো আছে সেই অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক বিচারিক কার্যক্রম শুরু হবে।
আশুলিয়ায় নিহত ছাত্র-জনতার লাশ স্তুপ করে পোড়ানো : মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ছাত্র আন্দোলনে বিজয়ের দিন ৫ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত নিপীড়ক পুলিশ, স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলাম ও তার ক্যাডার বাহিনী ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে আশুলিয়ায় নিহত হন অন্তত ৩১ জন। পরদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ১৫ জন মারা যান। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল দেড় হাজারের বেশি মানুষ। যাদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে যান। সাভার ও আশুলিয়ায় ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা যায় অন্তত ৭৫ জন। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে লাশ পোড়ানোর একটি ভিডিও। মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও লোমহর্ষক ওই ঘটনায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ছিল ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের।
ভিডিওতে দেখা যায়, দুজন পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা একজনকে হাত ও পা ধরে ভ্যানে নিক্ষেপ করছেন। সেই ভ্যানে আরও লাশ রয়েছে। সর্বশেষ লাশটি তুলে একটি ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। পরে সেখানে আরও পুলিশ সদস্যের উপস্থিতি দেখা যায়। ভিডিওর ১ মিনিট ৬ তম সেকেন্ডে একটি পোস্টার দেখা যায়, যা স্থানীয় ধামসোনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রার্থী ও ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেনের। সেই পোস্টারটি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় ভিডিওটির ঘটনাস্থল আশুলিয়া থানার পাশে। পুলিশ ভ্যানভর্তি লাশগুলো থানার সামনে নিয়ে যায়। পরে ভ্যানে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি অভিযোগ করা হয়। দুটি অভিযোগই অভিন্ন হওয়ায় একটি মামলা হয়। এ মামলায় গত ২৪ ডিসেম্বর স্থানীয় এমপি (সাবেক) সাইফুল ইসলামসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তিনি এখনো পলাতক। তবে মামলার অন্য অভিযুক্ত ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, তৎকালীন ওসি এ এফ এম সায়েদ, ডিবি পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক এবং কনস্টেবল মুকুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত ১৫ এপ্রিল গ্রেপ্তার তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আগামী ২৮ এপ্রিল এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন রাখেন ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
তিন পুলিশ কর্মকর্তা হলেন- ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম ও সাবেক ডিবি পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থায় এখন পর্যন্ত ৩৩৯টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এবং এই সব অভিযোগের ওপর ট্রাইব্যুনালে ২২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে প্রসিকিউশন থেকে জানানো হয়েছে। আর এই মামলাগুলোয় মোট ১৪১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ৫৪ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকি ৮৭ জন পলাতক রয়েছেন বলে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন থেকে জানানো হয়েছে।
পলাতক আসামীদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে। তবে ট্রাইব্যুনাল থেকে ওয়ারেন্ট বের হওয়ার তথ্য আগেই আসামীর কাছে চলে যাওয়ায় পালানোর মত কিছু ঘটনা ঘটেছে। আর বিদেশে যারা পালিয়ে গেছে তাদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। এখানে কূটনৈতিক দুইটি ধাপে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় বলে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, বিদেশে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করা হয়েছে, যা বর্তমানে ইন্টারপোলের নিজস্ব পদ্ধতির মধ্যে আছে।