
পুঁজিবাজার থেকে মুনাফা করার আশা ‘নিরাশা’য় পরিণত হয়েছে। উল্টো দিনে দিনে পুঁজি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকার পতনের পর আশায় বুক বেঁধেছিলেন ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারী। কিন্তু সেই বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ এখন পথে নেমেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে চলা পতন থামছে না কোনো উদ্যোগেই। চলমান অস্থিরতার মধ্যে ভালো কম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়াকে ‘আশঙ্কাজনক’ বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে দরপতনের প্রধান কারণ হচ্ছে আস্থার অভাব। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে উচ্চ সুদের হার, মার্জিন ঋণের বিপরীতে কেনা শেয়ার বিক্রি (ফোর্সড সেল), নিয়ন্ত্রক সংস্থায় অস্থিরতাসহ নানা কারণে অনেকে বাজার ছাড়ছেন। ভালো ব্যাংকগুলো এখন আমানতের ক্ষেত্রে ১১ শতাংশের ওপরে সুদ দিচ্ছে, অন্যদিকে ট্রেজারি রেটও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এর প্রভাবে শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ সরে গেছে এবং বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একসময় পুঁজিবাজারে ৩৩ লাখ সক্রিয় বিনিয়োগকারী ছিলেন, এখন তা নেমেছে ১২ লাখে।
পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে ব্যাপক সংস্কারের কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার, যার জের ধরে দেশের ব্যাংক খাতসহ কয়েকটি খাতে উন্নতি দৃশ্যমান। কিন্তু এখনো পুঁজিবাজারে সংস্কারের কোনো প্রভাব নেই। তাই আস্থার সংকট কাটেনি। এখন আস্থা ফেরানোর বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের কাছে মুখ্য। পুঁজিবাজার যে অবস্থায় পৌঁছেছে তাতে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের পদক্ষেপ ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না। বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুঁজিবাজারে সূচক দুই মাস ধরে নিম্নমুখী অবস্থানে আছে।
যদিও আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সূচকের সাময়িক উত্থান হয়েছিল। সরকার বদলের পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নেতৃত্বের বদল হলেও বাজারে কোনো আশার আলো দেখা যায়নি। বিদ্যমান সংকটেরও যেন কোনো সমাধান নেই। এ কারণে বাজার কেবলই দরপতনের একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সর্বশেষ কার্যদিবস গত বৃহস্পতিবারও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স পতন হয়েছে ৫০ পয়েন্ট। এ নিয়ে টানা ৯ কর্মদিবস ধরে এই প্রধান সূচকের পতন চলছে। এই ৯ কর্মদিবসে প্রধান সূচকের পতন হয়েছে ২৩৩ পয়েন্ট। পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক দরপতনের ফলে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৪ হাজার পয়েন্টের ঘরে নেমে এসেছে। এদিন ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে মাত্র ৩৬৭ কোটি টাকা। এক সপ্তাহে বাজার মূলধন কমেছে ১৩ হাজার ১৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সিএসসিএক্স সূচক আগের দিনের চেয়ে ২৫.৬০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৮ হাজার ৫২৪ পয়েন্টে। সিএসইতে সাত কোটি ১৩ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।
গত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর পুঁজিবাজারের হাল ধরেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। ওই দিন ডিএসইর প্রধান ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫৭৭৫.৪৯ পয়েন্টে। তিনি কাজে যোগ দেওয়ার আট মাস অতিবাহিত হলেও পুঁজিবাজারে গতিশীলতা ফিরে আসেনি। বরং বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা বেড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত আট মাসে ডিএসইএক্স সূচক ৮০২.৯০ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯৭২ পয়েন্টে। বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলেও অনেক বিনিয়োগকারী মনে করেন।
এদিকে পুঁজিবাজারে টানা দরপতনে পুঁজি হারিয়ে ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে অপসারণের দাবিতে প্রায়ই রাজধানীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করছেন।
বিক্ষোভকালে বিনিয়োগকারীরা বলেন, পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন ঘটছে এবং প্রতিদিন বিনিয়োগকারীরা তাঁদের শেয়ার ফোর্সড সেলে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁদের বিনিয়োগের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ হারিয়ে গেছে। এখন তাঁদের কোনো আস্থা নেই বর্তমান নেতৃত্বে। তাঁদের এখন মূল দাবিই হলো বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ, পদত্যাগ করলেই পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে।
চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে বিএসইসিতে সম্প্রতি সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল, এর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা।
জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শেয়ারবাজারের সঙ্গে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি জড়িত। দেশে বিনিয়োগ নেতিবাচক অবস্থায় আছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ শতাংশ। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বল্পকালীন সরকার থাকে, ততক্ষণ বিনিয়োগকারীরা নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। এই পরিস্থিতির মধ্যে দেশে তেমন বিনিয়োগ হয় না। বিনিয়োগ যদি না হয়, মানুষ ব্যবসা সম্প্রসারণ না করে, তাহলে পুঁজিবাজার গতিশীল থাকবে না। এতে ভালো আইপিও আসবে না, ব্যবসা ভালো না চললে লভ্যাংশও ভালো আসবে না। এ রকম পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে ভালো প্রবৃদ্ধি আশা করা যায় না। হবে হয়তো, তবে তার জন্য সময় লাগবে।’
বিএসইসির এই সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, অত্যন্ত সংবেদনশীল এই বাজারকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা বাস্তবায়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিছুটা তাড়াহুড়াও করেছে। এটি আগে থেকে আস্থা সংকটে থাকা বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরো কমিয়েছে। এর প্রভাবেও শেয়ারবাজারের পতন হচ্ছে।
ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চলমান দরপতনের মূলে আছে ব্যাংকের সুদের হার বেড়ে যাওয়া। সঞ্চয়পত্র ও বন্ডের সুদের হার বাড়ানোও এর অন্যতম কারণ। ব্যাংকে হতাশা ছড়ানোর কারণে কয়েকটি ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমে গেছে। আমাদের তালিকাভুক্ত কম্পানির ৪০ শতাংশই হলো ব্যাংক। এই কারণে শেয়ারবাজারে দরপতন ত্বরান্বিত হয়েছে।’
শাকিল রিজভী বলেন, ‘আগে বন্ডের সুদের হার ছিল ৬ শতাংশ। এখন তা বাড়িয়ে ১১-১২ শতাংশ করা হয়েছে। এতে শেয়ারবাজারে চাপ পড়বেই। আগের সরকারের সমর্থিত যাঁরা ব্যবসায়ী ছিলেন তাঁদের ওপরও চাপ বেড়েছে। তাঁদের কম্পানিগুলো ভালোভাবে চলছে না। অভ্যন্তরীণ এসব সমস্যা এড়িয়ে গেলে চলবে না। অর্থনীতি সংস্কারের কাজ চলছে। সংকটগুলো ধীরে ধীরে কাটছে। পুঁজিবাজার দেশের পরিস্থিতির বাইরে নয়, আশা করি, দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে শেয়ারবাজারের পরিস্থিতিও ভালো হবে। পুঁজিবাজারে উন্নতি না হোক কিন্তু প্রতিদিন কমে যাবে কেন—এটাই আশাঙ্কার বিষয়। আস্থার ঘাটতি যদি থাকে তাহলে তা ফেরাতে স্টেকহোল্ডারসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর আস্থার ঘাটতি থাকলে চলবে না।’
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে, মূল্যস্ফীতি কমতির দিকে যাচ্ছে, ডলারের বাজার এখন স্থিতিশীল রয়েছে। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কম, বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে, সুদের হারও বাড়তি। এসব কারণে ট্রেজারি বন্ড অনেক টাকা নিয়ে গেছে পুঁজিবাজার থেকে। ট্রেজারি বন্ডে তারা সাড়ে ১২ শতাংশ সুদ পাচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই শেয়ারবাজারে আগ্রহ কমেছে। যারা মার্জিন ঋণ নিয়েছে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুদের হার বেশি হওয়ায় তারা লাভ করতে পারছে না। তাদের অনেকে ফোর্সড সেলের শিকার হচ্ছে।’
এই পুঁজিবাজার বিশ্লেষক বলেন, মার্কেটে সরবরাহ ঠিক থাকছে না। মিউচুয়াল ফান্ডগুলো তেমন কিছুই করতে পারছে না। শেয়ারবাজারের অপশনগুলো কমে গেছে। আগের মতো মার্জিন ঋণ নিয়ে ট্রেডিং করে লাভ করবে, তা আর হয়ে উঠছে না। এগুলো নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। আইসিবিরও বিনিয়োগ সক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু একসময় না একসময় শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। দলীয় সরকার ক্ষমতা আসার আগেই শেয়ারবাজার চাঙ্গা হতে পারে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি ও ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজের পরিচালক সাইফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে দরপতনের প্রধান কারণ হচ্ছে প্রচণ্ড আস্থার অভাব। বিনিয়োগকারীরা কোনোভাবেই আস্থা ধরে রাখতে পারছেন না। মধ্যস্থতাকারী বা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আমরাও কোনোভাবেই বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গা দেখাতে পারছি না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বলতে যা বোঝায় তা আমরা তৈরি করতে পরিনি। এখন এনবিএফআইও অস্তিত্ব সংকটে আছে। দু-তিনটি বাদে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন খারাপ অবস্থায় আছে। ব্যাংকের ক্ষেত্রেও ৮ থেকে ১০টি ব্যাংক শুধু ভালো অবস্থানে আছে। বিনিয়োগ করার মতো খুব কমসংখ্যক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আছে।’
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএসইসির মূল কাজ হলো কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকরণ এবং বাজারকে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা। বাজার উন্নয়নে কোনো নীতি সহায়তা লাগলে সেটা কমিশন দিচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে বাজার যাতে স্থিতিশীল হয় তার জন্য সংস্কারকাজ চলছে। ভালো আইপিও, ভালো সিকিউরিটিজ না আসায় বিগত বছরগুলোতে বেশি বিনিয়োগকারী আসেনি। এ জন্য আমরা সহায়তা দিচ্ছি। নেগেটিভ ইকুইটি সমন্বয়ের মেয়াদ আমরা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছি। আমরা আশা করছি, সংস্কারের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হবে।’