
দেশের জ্বালানি খাতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডে (এসএওসিএল) ‘পুকুরচুরি’ করেও বহাল তবিয়তে দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালরা। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের ৪৭২ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে বার্ষিক অডিট প্রতিবেদনে। ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হলেও আজও তা আলোর মুখ দেখেনি।
এসএওসিএলে নিয়ম না মেনে এলসির বিপরীতে চেকে অর্থ লেনদেন, অগ্রিম নগদ টাকা দেওয়া, অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য, জমি কেনা ও মামলা পরিচলনায় অতিরিক্ত ব্যয়, লিফট না কিনে ব্যয় দেখানো, কর্মকর্তা ও পরিচালকের ব্যক্তিগত জীবন বীমার টাকা প্রতিষ্ঠান থেকে পরিশোধসহ রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা যোগসাজশে এমন পুকুর চুরি করলেও এখনো রয়েছেন স্বপদে।
২০১৩-১৪ থেকে ২০১৯-২০, ছয় অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানের ২১টি খাত থেকে ৪৭২ কোটি ৭৪ লাখ ৮ হাজার ৫৪৭ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মেলে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বার্ষিক অডিট প্রতিবেদনে।
বিশাল এ কারচুপিতে অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন— এসএওসিএলের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বর্তমানে বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মণিলাল দাশ, সাবেক ব্যবস্থাপক (হিসাব ও অডিট) এবং ব্যবস্থাপক (এডমিন) বেলায়েত হোসেন, সহকারী ব্যবস্থাপক আতিকুর রহমান, মংলা অয়েল ইনস্টলেশনের সাবেক কো-অর্ডিনেটর ও বর্তমানে ব্যবস্থাপক কামরুল হোসেন, বিপিসির ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) এটিএম সেলিম, সাবেক মহাব্যবস্থাপক (নিরীক্ষা) ও বর্তমানে এলপিজিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউসুফ হোসেন ভূঁইয়া।
যেভাবে হাতানো হয় অর্থ
নিয়ম অনুযায়ী এলসি সংক্রান্ত কাজে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন হয়। ক্রেতার ব্যাংক থেকে অর্থ স্থানান্তর করা হয় বিক্রেতার ব্যাংকে। সেখানে চেক ইস্যুর প্রয়োজন না থাকলেও ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে গালফ পেট্রোকেম পিটিই ও গালফ পেট্রোলিয়াম পিএলসি নামের দুই প্রতিষ্ঠানের নামে ‘নন অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকে’ নগদ ৬৩ কোটি ১১ হাজার ৫৭৩ টাকা তুলে নেওয়া হয়।
২০১১-১২ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দাপ্তরিক প্রয়োজন দেখিয়ে সাবেক ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা কমিটি-ম্যাকের সভাপতি মঈনউদ্দিন আহমেদকে দাপ্তরিক প্রয়োজন দেখিয়ে অগ্রিম নগদ টাকা দেওয়া হয়। অগ্রিম টাকার বিপরীতে তার কাছ থেকে চেক নিয়ে সেটি ব্যাংকে জমা না করে পরবর্তী অর্থবছরের এ চেক ফেরত দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ৮৬ কোটি ৭৪ লাখ ৪৪ হাজার ৪৫৭ টাকা আত্মসাতের সুযোগ তৈরি করা হয়।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানির অনুকূলে বিটুমিন ক্রয় বাবদ ‘নন অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকে’ নগদে ২ কোটি ২৩ লাখ ৬ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয় এবং জালিয়াতির মাধ্যমে এ চেক ইস্যুর বিপরীতে পেমেন্ট ভাউচারও তৈরি করা হয়।
৩০ জুন অগ্রিম উত্তোলনের ভাউচার ও নগদ জমার অর্থ সমন্বয় করার কথা থাকলেও তা না করে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২৮টি লেনদেনের মাধ্যমে ২৩ কোটি ১১ লাখ ১১ হাজার ৮৯৬ টাকা তুলে নেয় সাবেক ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা কমিটি-ম্যাকের সভাপতি মঈনউদ্দিন আহমেদ।
নিয়ম না মেনে বাকিতে ম্যাক সভাপতি মঈনউদ্দিন আহমেদ লুব্রিকেন্ট অয়েল কিনতেন। বকেয়া অর্থ পরিশোধের চেক ব্যাংকে জমা না করে কর্মকর্তার স্বাক্ষর ছাড়াই ব্যাংক বুকে জমা দেখানো হতো। ২০১১-১২ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া ওই চেক ব্যাংকে জমা না করে ১৯৪ কোটি ৬৬ লাখ ১১ হাজার ৯৮৬ টাকা বকেয়া রয়ে যায়।
২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এলসির মাধ্যমে ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৬০ ড্রাম বিটুমিন আমদানি করা হয়। এর মধ্যে আমদানি ও বিক্রয়ে গরমিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩২৫ ড্রাম বিটুমিনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। যার মূল্য দাঁড়ায় ৬৮ কোটি ৫১ লাখ ৬২ হাজার ৬৪৫ টাকা। একই অর্থবছরে আমদানি করা বিটুমিন বিক্রির অর্থ অনাদায়ী দেখিয়ে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮৪ হাজার ৩০০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এলসির মাধ্যমে আনা ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৬০ ড্রাম বিটুমিন খরচের অপেক্ষা অনেক কম মূল্যে বাজারজাত করায় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয় ৫ কোটি ৩ লাখ ৫২ হাজার ৮০ টাকা।
২০১৩-২০১৪ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসএওসিএলের লুব বেইজ অয়েল ও বিটুমিন আমদানি সংক্রান্ত কাজের ব্যয় হিসাবে বেসরকারি ইউনাইটেড অয়েল কোম্পানি ও ইউনাইটেড ট্রোকেমিক্যালের নামে ‘নন পেইয়ি চেক’ ইস্যু দেখিয়ে নগদ ১ কোটি ৮৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫৬৫ টাকা তুলে নেওয়া হয়।
২০১৬-২০১৭ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ম্যাক সভাপতি ও জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. শাহেদের নামে মেটলাইফ আমেরিকা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির জীবন বীমা করা হয়। তাদের পাঁচ বছরের বীমার ৩৮ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭০ টাকা পরিশোধ করা হয় প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে!
এলসি সংক্রান্ত কাজে ব্যাংকিং চ্যানেলে ব্যাংক টু ব্যাংক লেনদেন হয়। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এলসির বিপরীতে আমদানি করা লুব বেইজ অয়েলের মূল্য বিভিন্ন ভাউচারের চেক ইস্যু দেখিয়ে ৪ কোটি ৭৭ লাখ ৭২ হাজার ৮৫২ টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়।
২০১৮ সালে স্কাই মডার্ন হোমস প্রাইভেট লিমিটেডকে একটি কাজের অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই কাজের ২০টি আইটেমের জন্য নির্ধারিত বাজার দরের চেয়ে বাড়তি বিল পরিশোধ করা হয়। এতে কোম্পানির ক্ষতি হয় ১ কোটি ৪ লাখ ১৭ হাজার ৩৪৩ টাকা।
এসব অভিযোগের প্রমাণ মিলে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অডিট প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনে সংসদীয় কমিটি থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও এখন পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
দুদকের মামলা
চলতি বছরের ৪ মার্চ এসএওসিএলের তিন কর্মকর্তাসহ আটজনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
মামলায় বেলায়েত হোসেন, কামরুল হোসেন, আতিকুর রহমান, এমআই চৌধুরী অ্যান্ড কোং (ডিটিজি) লিমিটেডের পরিচালক ফেরদৌস আরা, চেয়ারম্যান মো. ফাইয়াজ ফারহান, ফেমাস ইলেক্ট্রিক অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স প্রোপাইটর হারিছ উদ্দিন ও নগরের সদরঘাটের দক্ষিণ নালাপাড়ার বাসিন্দা নারায়ণ চক্রবর্তী ও তার স্ত্রী রীতা চক্রবর্তীকে আসামি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিউল্লাহ আমার দেশকে বলেন, বিষয়টি নোট নিয়েছি। কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।