
অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, সার্বিক উন্নয়ন এবং প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে উষ্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করা দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এর জন্য রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ সরকারের বিকল্প নেই। আর তা পেতে হলে দরকার দ্রুত সংসদ নির্বাচন।বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত দেশের কয়েকজন অরাজনৈতিক ব্যক্তির তৈরি করা এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন যে সরকার হবে তাকে অবশ্যই অভিজ্ঞ হতে হবে। তা না হলে নতুন যে সরকার আসবে এবং তার সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে সেগুলো মোকাবেলা করা কঠিন হবে, এমনকি দেশ নতুন করে সংকটে পড়তে পারে।
প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। তবে পুরো সরকার যেভাবে একটি ‘টিম’ হিসেবে কাজ করার কথা তা হয়ে ওঠেনি বলেও মন্তব্য করা হয়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারে অভিজ্ঞ উপদেষ্টা কম। ফলে মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো যেভাবে করা দরকার সেভাবে হচ্ছে না।
প্রতিবেদনটি তৈরির সঙ্গে যুক্ত একজন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পতনের পর রাষ্ট্রের স্বাভাবিক অবস্থা ব্যাহত করতে এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিনিয়ত নানামুখী চাপে রাখতে পরাজিত শক্তিগুলো গোপনে ও কৌশলে কাজ করছে। ফ্যাসিবাদী শক্তিকে অগণতান্ত্রিক পন্থায় কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, সেটি নিয়েও তৎপরতা রয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে দূরে সরিয়ে না দিয়ে তাদের পরামর্শ নিয়ে এবং তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পথ চলা উচিত। এই সরকারের প্রধান লক্ষ্যই যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দেশকে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটানো, সেটিও বারবার স্পষ্ট করে বলা উচিত। তারা যে একটি অবাধ নির্বাচনের পথে এগোচ্ছেন, সরকারের কার্যক্রমে তা আরো দৃশ্যমান হতে হবে।’
সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার সাম্প্রতিক বক্তব্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি মানুষের আস্থা থাকলেও সরকারের কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তির কার্যক্রম উদ্বেগজনক। বিশাল জনপ্রত্যাশার চাপ সামলাতে ড. ইউনূস যতটা আন্তরিক, তার ঠিক উল্টো পথে আছেন কিছু উপদেষ্টা। কিছু উপদেষ্টা রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণেও তৎপর। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করতে শুরু করেছে।
এসব বিষয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. মাহবুব উল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত লেখক-গবেষক ও বামপন্থী রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরের দেওয়া সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করেন এবং ওই বক্তব্যের সঙ্গে একমত বলে জানান।
ওই সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, ‘সরকারের উচিত এই বছরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া।’
অন্তর্বর্তী সরকার যে নিজ থেকে আসেনি, ছাত্রনেতা ও অন্যরা এই সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। কোন প্রেক্ষাপটে সরকার গঠন হয়েছে, সে বিষয়ে পরিষ্কার বক্তব্য দেন বদরুদ্দীন উমর। পাশাপাশি সরকারের কাজের পরিধি কী হওয়া উচিত সে বিষয়েও নিজের মতামত জানান তিনি।
ড. মাহবুব উল্লাহ এ বিষয়গুলো উল্লেখ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার জোর করে ক্ষমতায় আসেনি। সব দল ও মহল মিলে তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে। সরকার পরিচালনায় কিছু ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য আছে। কিন্তু তারা নির্বাচিত সরকার নয়। দীর্ঘদিন অনির্বাচিত সরকার থাকলে নানা জটিলতা দেখা দেয়। নির্বাচিত সরকারের যে শক্তি থাকে, সেটি এই সরকারের নেই।’
বদরুদ্দীন উমর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সাময়িকভাবে তাদের যে পরিস্থিতি মোকাবেলার কথা ছিল, সেটা সরকার করেছে। নির্বাচনের জন্য যেসব প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, সেটা করে তাদের উচিত তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিয়ে দেওয়া। আমি মনে করি, এ বছরের মধ্যেই তাদের কাজ শেষ করা দরকার। সরকারের মেয়াদ বেশি দীর্ঘায়িত করা ঠিক হবে না। নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা দিয়ে দিতে হবে। তারপরের দায়িত্ব তাদের (নির্বাচিত সরকার)।’
এই বিষয়ে সম্প্রতি মাহবুব উল্লাহ এক লেখায় বদরুদ্দীন উমরকে উদ্ধৃতি করে বলেন, ‘নির্বাচিত সরকার দেশের মানুষকে দুধে-ভাতে রাখবে, এমন নয়; কিন্তু একটা নির্বাচিত সরকার হয়ে গেলে তাদের একটা শক্তি থাকে, সামাল দেওয়ার যে ক্ষমতা, সেটা থাকে। বেশি দিন যদি অস্থায়ী সরকার থাকে, দেশে নানা রকম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সেটা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সব সংস্কার তাদের করতে হবে, তা তো নয়।’
ভূ-রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি
প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কারণে বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার মতো অবস্থায় আছে। বিশ্বের খ্যাতনামা শাসকদেরও তিনি সমর্থন পাচ্ছেন। তবে প্রভাশালী রাষ্ট্রগুলো দ্রুত নির্বাচনও চায়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী। দেশের বেশির ভাগ মানুষ ভারত বিদ্বেষী হলেও প্রতিবেশী পরিবর্তন করা যাবে না। ফলে নতজানু না হয়ে দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখতে হবে। তবে ভূ-রাজনীতিতে পটপরিবর্তন হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্বরাজনীতিতে দ্রুত বদল হতে শুরু করেছে। এসব বিষয় সিদ্ধ হস্তে মোকাবেলা করতে অভিজ্ঞ সরকার দরকার।
কতটুকু চাঁদাবাজি, কতটুকু অপপ্রচার
বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির অভিযোগ, মিডিয়া ট্রায়াল ও অন্তর্বর্তী সরকারকে ৫ থেকে ১০ বছর ক্ষমতায় রাখার ক্যাম্পেইন নিয়েও প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কেবল নিষ্পেষিত হয়নি, নিঃস্বও হয়েছে। ফলে ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পালিয়ে গেলে বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি অংশ আপনা-আপনি ‘ক্ষমতায়িত’ হয়ে নানা শৃঙ্খলাবহির্ভূত কাজে যুক্ত হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে দলের বদনাম হতে পারে জেনেও তারা নিজ নিজ এলাকায় নিজেদের প্রভাব সৃষ্টি এবং অর্থের বিদ্যমান স্রোতের সঙ্গে মিশে গেছেন। এমন অনেকের বিরুদ্ধে বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে যে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে, প্রতিবেদনে তাকে সময়োচিত পদক্ষেপ বলা হয়।
প্রতিবেদনে চাঁদাবাজির পাশাপাশি মিডিয়া ট্রায়ালের বিষয়েও বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। ওই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কেউ কেউ ছোট ঘটনাকেও বাস্তবতার চাইতে বড় করে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে বিএনপিকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রে কিছু গণমাধ্যমের পাশাপাশি একটি পক্ষ সোশ্যাল মিডিয়ায় খুবই সক্রিয় রয়েছে। প্রতিবেদনে এর জন্য জামায়াত ও এনসিপির নেতাকর্মীদের দায়ী করা হয়।
প্রসঙ্গত, ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে বিএনপি অন্তত তিন হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। বিএনপিকে এত কঠিন হতে অতীতে কখনো দেখা যায়নি বলে দলের ভেতরেই আলোচনা রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে ৫ থেকে ১০ বছর ক্ষমতায় রাখার প্রচারণার পেছনেও সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা রয়েছে বলে মনে করছেন প্রতিবেদন প্রণয়নে যুক্ত ব্যক্তিরা। তাঁরা বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের যে দাবি বিএনপি তুলেছে, সেই দাবির বিপক্ষে পাল্টা মতামত তুলে ধরতেই এ ধরনের ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে। এই প্রচারণার সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই পক্ষটি মনে করছে, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে ভোটের মাঠে তারা তেমন সুবিধা করতে পারবে না।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক দিলারা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপি নেতাকর্মীরা কিছু অপকর্মে জড়িত আছেন—এমন প্রচার থাকায় তারেক রহমান অভিযুক্তদের ধরে পুলিশে দিতে বলেছেন। এখন দায়িত্ব সরকারের। তবে এটা বলতে পারি, বিএনপিকে ঘায়েল করার এক ধরনের চেষ্টা আছে। এটা দেশকে বিরাজনৈতিকীকরণের নীলনকশার অংশ।’