
রাজশাহীর পদ্মায় অর্ধশতক আগে ঝাঁকে ঝাঁকে মিলত ইলিশ। স্বাদে ও ঘ্রাণে এ ইলিশ ছিল অতুলনীয়। আকারে মাঝারি ও বড় ইলিশ ছিল সহজলভ্য। সাধারণ মানুষ সহজেই অত্যন্ত সুস্বাদু এ মাছটির স্বাদ নিতে পারতেন। কিন্তু পালটেছে পরিস্থিতি। পদ্মার উজানে মরণবাঁধ ফারাক্কার থাবায় কমেছে পানির প্রবাহ। আর এ কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে পদ্মার ইলিশ। পাশাপাশি পদ্মা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছও। ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মা নদীর আয়তন অর্ধেকে নেমেছে। পদ্মায় নেই পানি। চারদিকে এখন শুধু বালু আর বালু। ফলে খাদ্য ও আবাস সংকটে পড়েছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। মৎস্য প্রজাতির ৬০ শতাংশই এখন বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গবেষকরা বলছেন, পদ্মায় পানি কমে যাওয়ায় এখন ইলিশ সেভাবে নিচু এলাকা থেকে উজানে আসে না। বিশেষত নদীতে পানির গভীরতা কমে যাওয়া, বাঁধ দেওয়া এবং ফিল্টারেশন বেশি হওয়ার (ড্রেজিংয়ের কারণে পানিতে বালুর পরিমাণ বেড়ে পানি ঘোলা হয়ে যাওয়া) কারণে ইলিশ আসা কমে গেছে। পানির গভীরতা ২০ থেকে ২৫ ফুট না হলে মাছ আসতে চায় না। রাজশাহীর বিশিষ্ট নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ইলিশ দ্রুত বেগে ছোটে এবং উজানের দিকে যেতে পছন্দ করে। চলাচল করে ঝাঁকে ঝাঁকে। পাকিস্তান আমলেও বঙ্গোপসাগর থেকে উজানে রাজশাহী হয়ে ভারতের ভাগলপুর পর্যন্ত যেত ইলিশ এবং ডিম ছাড়ত। ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর রাজশাহীতে ইলিশ কমতে থাকে। তিনি বলেন, বাঁধের কারণে পদ্মায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় স্রোতও কমে গেছে। ফলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অতিক্রম করে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসা বন্ধ হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ১৯৭৪-৭৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহীতে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যেত। তবে আশির দশক থেকেই পদ্মায় কমতে থাকে ইলিশের পরিমাণ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা নদীর চেহারা পালটাতে শুরু করে ১৯৭৫ সালের পর। ওই বছর পদ্মার ১৮ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত। এ বাঁধ দিয়েই ভাগীরথী ও হুগলি নদীতে পানি প্রত্যাহার শুরু করে প্রতিবেশী দেশটি। এর প্রভাবে পানি কমতে শুরু করে পদ্মায়।
গবেষকরা জানান, ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহিত হতো ৯ হাজার ৩২ ঘনমিটার। বাঁধ চালুর পর থেকে অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রবাহ নেমেছে ৫ হাজার ১৪৬ ঘনমিটারে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫০৭ টন, ২০১৯-২০-এ ৭৩৫ টন, ২০২০-২১-এ ৭৪১ টন, ২০২১-২২-এ ৫৮১ টন, ২০২২-২৩-এ ৬০০ টন এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৯২ টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছর এখনো শেষ না হওয়ার কারণে এ মৌসুমের হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এ মৌসুমে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আরও কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে মৎস্য অধিদপ্তর রাজশাহী জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার পবা, চারঘাট, বাঘা ও গোদাগাড়ী এলাকার পদ্মা নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়। এর মধ্যে চারঘাটে পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি। চলতি বছর এখনো ইলিশের মৌসুম শুরু হয়নি। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে চারঘাটে ৩ হাজার ২০০ কেজি ইলিশ ধরা পড়েছে; আগস্টে ২ হাজার ৮৩০ কেজি ও জুলাইয়ে ধরা পড়েছে ১ হাজার ৪৪৬ কেজি ইলিশ। তবে বেশিরভাগ ইলিশই আকারে ছোট। পাঁচ থেকে ছয়টি মিলে এক কেজি হয়।
সূত্র আরও জানায়, রাজশাহী জেলায় গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে চারটি উপজেলায় ৫.৩৭ টন ইলিশ ধরা পড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৮.৫৫ টন ইলিশ ধরা পড়লেও পরের বছর থেকে ইলিশ আহরণ কমতে শুরু করে। মাত্র ৮ বছরের ব্যবধানে রাজশাহীতে ইলিশের আহরণ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইলিশ এমন একটি মাছ, যেটি সমুদ্র এবং নদী উভয় জায়গায় বিচরণ করে। ইলিশের যৌবনপ্রাপ্তির জন্য সমুদ্রে বসবাস করতে হয়। আর ডিম ছাড়ার জন্য মাছটি নদীতে আসে। কারণ ইলিশ সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে ডিম দিতে পারে না। ডিম দিলেও নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য স্বাদু পানি প্রয়োজন। স্বাদু পানিতে ডিম দিলে তা নষ্ট হয় না। এছাড়া যত বেশি উজানে যাবে তত বেশি ডিম থেকে ইলিশ পাওয়ার হারও বাড়বে।
অপরদিকে ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মা নদীর আয়তন অর্ধেক কমেছে। এতে পানির গভীরতার পাশাপাশি কমেছে প্রবাহ। ফলে আবাসস্থল হারিয়ে এখন বিলুপ্তির আশঙ্কায় বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ। রয়েছে খাদ্য সংকটও। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশন’র ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর মিঠা পানির সরবরাহ সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সারদা পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশ নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। ওই এলাকার নয়টি পয়েন্টে মৎস্য প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পদ্মা পাড়ের ২৭টি জেলেপল্লি থেকে নেওয়া হয় তথ্য। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে পদ্মার বর্তমান চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছেন গবেষক দলের সদস্যরা।
গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের হরিশংকরপুর গ্রামের আফজাল হোসেন পেশায় জেলে। বাপ-দাদার সময় থেকে এ পেশায় জড়িয়ে থাকলেও এখন আর পোষাচ্ছে না বলে জানান তিনি। বলেন, শৈশব থেকেই পদ্মায় মাছ শিকার করছি। আগে যেখানে কয়েক মন মাছ পেতাম, এখন তা কেজিতে নেমে এসেছে। ফলে সংসার চালাতে পারছি না। হয়তো অচিরেই এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন কোনো কাজ করতে হবে। ইতোমধ্যেই অনেকেই মাছ শিকার ছেড়ে কৃষিশ্রমিক হিসাবে কাজ করছেন।
এদিকে ২০০৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চালানো এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পদ্মায় দেশীয় ৭৭ প্রজাতির মাছের মধ্যে তিনটি প্রজাতির অবস্থা সংকটজনকভাবে বিপন্ন, ১০টি প্রজাতি বিপন্ন, ৯টি প্রজাতি অতি বিপন্ন এবং আরও ৯টি প্রজাতি বিপন্ন প্রায় অবস্থায় রয়েছে। পদ্মা থেকে হারিয়ে যাওয়া মৎস্য প্রজাতির ৬০ শতাংশই এখন বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তর রাজশাহী জেলার তথ্যমতে, পদ্মা নদী থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশীয় মাছ আহরণ হয়েছে ১ হাজার ৮৫০ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ২ হাজার ৪০ টন, ২০২১-২২-এ হয়েছিল ২ হাজার ১৫২ টন, ২০২০-২১-এ ২ হাজার ২২১ টন এবং ২০১৯-২০-এ আহরণ হয়েছিল ২ হাজার ২৮৩ টন। প্রতিবছরই মাছ আহরণের পরিমাণ কমছে। গত ৫ বছরে মাছ আহরণ কমেছে ৪৩৩ টন। তবে শেষ না হওয়ার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজশাহীর পদ্মা নদী থেকে মাছ আহরণসংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, ২০১২ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, নদীতে ৮২ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। ২০২২ সালে তা কমে ৫২-তে নেমেছে। ধারাবাহিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মৎস্যসম্পদ। এ ছাড়া রুই, কাতল, বাঘাইড়, বোয়াল, ঘেড়াসহ অনেক প্রজাতির মাছ দিন দিন কমছে নদীতে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়াই এর মূল কারণ। পদ্মায় ইলিশ এবং দেশীয় প্রজাতির মাছ ফেরাতে হলে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এটি না করলে পদ্মা থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে ইলিশ এবং দেশীয় প্রজাতির মাছ।