Image description
 

জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে অনেক মানুষ দরিদ্রতার মধ্যে পড়ছে। বিষয়টি বিবেচনায় ব্যয়বহুল চিকিৎসায় স্বাস্থ্যবিমা চালুর পক্ষে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার কমিশন। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ প্রস্তাব দিয়ে শুরুতে চার থেকে পাঁচটি ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য বিমা-সুবিধা দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে পরামর্শ দেবে কমিশন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যানসার, ডায়ালাইসিস, কার্ডিয়াক সার্জারি ও পক্ষাঘাত।

সংস্কার কমিশন বলেছে, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সরকারের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে ব্যয়বহুল চিকিৎসাগুলোকেও অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে। সংস্কার কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

স্বাস্থ্যবিমার প্রস্তাবকে ভালো বললেও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এটি বাস্তবায়নের উপায়ও কমিশনকে বলতে হবে। জাতীয় স্বাস্থ্য তহবিল ছাড়া সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

গত বছরের ১৮ নভেম্বর ১২ সদস্যের স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনের প্রধান করা হয়েছে জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানকে। প্রতিবেদন দিতে কমিশনকে প্রথমে ৯০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। পরে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম দফায় ৩০ মার্চ পর্যন্ত এবং মার্চের শেষে দ্বিতীয় দফায় ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়।

কমিশনের অন্তত তিন সদস্য আজকের পত্রিকাকে জানান, তাঁদের মাঠপর্যায়ের সব কার্যক্রম মার্চের মধ্যেই শেষ হয়েছে। জেলা, বিভাগ, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চিকিৎসা শিক্ষা, ওষুধ, জনস্বাস্থ্য, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের বিষয়সহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করা হয়েছে।

 

মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মতামত, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনও আমলে নিয়েছে কমিশন। ইংরেজি ভাষায় তৈরি করা প্রতিবেদনটি বর্তমানে বাংলা ভাষায় চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

সূত্র বলেছে, কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার) বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। নিজস্ব ব্যয়ে চিকিৎসা করাতে বিপর্যয়ের পরিস্থিতিতে পড়ছে মানুষ। বিনা মূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত। তবে প্রাথমিক সেবার বাইরেও ব্যয়বহুল চিকিৎসাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রস্তাব থাকছে প্রতিবেদনে।

সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট বলছে, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৬৭ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশে এই ব্যয় ৭৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সূত্র বলছে, চিকিৎসার উচ্চব্যয়ের কারণে দেশের ১৮ শতাংশ পরিবার বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের মধ্যে পড়েছে। ২০২২ সালে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশে ৬১ লাখের বেশি মানুষ দরিদ্র হয়েছে।

সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য বলেন, স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের বিষয়টিতে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে গুরুত্ব দিতে সরকারকে প্রস্তাব করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে মানুষকে দরিদ্রতা থেকে বাঁচাতে কর্মপরিকল্পনা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ধনীরা চিকিৎসার জন্য কোটি টাকা ব্যয় করলেও বিপর্যয়ের মুখে পড়েন না। তবে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ দরিদ্র হন। কেউ কেউ সর্বস্ব হারান। অনেক সময় অর্থের অভাবে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। গবেষণার তথ্য ও অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে এমন চার থেকে পাঁচটি জটিল স্বাস্থ্য অবস্থা ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা শনাক্ত করা হয়েছে। যেগুলোর ব্যয় বিমা থেকে বহন করতে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হবে।

যেসব চিকিৎসা বিমার আওতায় আনার প্রস্তাব থাকছে

দেশে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ শতাংশই মারা যান অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি কয়েকটি রোগে। এর মধ্যে হৃদ্‌রোগ ও ক্যানসার শীর্ষে। এ ছাড়া পক্ষাঘাতগ্রস্তদের চিকিৎসা ও কিডনি বিকল রোগীদের ডায়ালাইসিস ব্যয়বহুল হওয়ায় চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন অনেক রোগী।

কমিশন সূত্র বলছে, ব্যয় বিবেচনায় কমিশন শুরুতে ডায়ালাইসিস, পক্ষাঘাত, করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং বা বাইপাস সার্জারি, ক্যানসারের চিকিৎসাকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার প্রস্তাব দেবে।

কমিশনের দুজন সদস্য বলেন, তাঁরা চার থেকে পাঁচটি অবস্থা নির্ণয় করেছেন। সরকার এগুলোর দু-তিনটি নিয়ে শুরু করতে পারে। পক্ষাঘাত, ডায়ালাইসিসের জন্য পুরো পরিবার মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়ে। ক্যানসারের চিকিৎসা, কার্ডিয়াক সার্জারি ব্যয়বহুল। যেসব খরচ একজন মানুষকে দারিদ্র্যসীমায় ঠেলে দিচ্ছে, তা নিয়ে সরকারের বিমা শুরু করা উচিত। এসব বিমার আওতায় এলে প্রতারণার সুযোগ থাকবে না। কারণ, কার্ডিয়াক সার্জারি, ক্যানসার বা ডায়ালাইসিস প্রয়োজন না হলে কোনো প্রতিষ্ঠান এসব নিয়ে প্রতারণা করতে পারবে না। শুরুতে সাধারণ রোগগুলোকে বিমায় রাখলে তা কার্যকর করা কঠিন। ধীরে ধীরে সব ধরনের চিকিৎসা স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা যাবে।

তবে দেশে এসব রোগের চিকিৎসা-সুবিধা অপ্রতুল। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের এক গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে কার্ডিয়াক সার্জারির সুবিধা থাকা প্রতিষ্ঠান আছে ৩২টি।

জাতীয় কিডনি ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট বলছে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি কিডনি ডায়ালাইসিস কেন্দ্র আছে ১৩০টি, ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে ৬৫০টি। অথচ দেশে ২ কোটি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে বছরে অন্তত ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার মানুষের কিডনি রোগ শেষ পর্যায়ে (পঞ্চম স্তর) পৌঁছায়। অর্থাৎ তাঁদের কিডনি প্রতিস্থাপনের বিকল্প নেই। প্রতিস্থাপন পর্যন্ত তাঁদের ডায়ালাইসিস করতে হবে। কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধা রয়েছে ১০টি প্রতিষ্ঠানে। ডায়ালাইসিস প্রয়োজন—এমন রোগীদের মাত্র ২৫ শতাংশ এই সুবিধার আওতায় আসছে। একইভাবে ক্যানসারের চিকিৎসা-সুবিধাও অপ্রতুল।

চিকিৎসা-সুবিধার অপ্রতুলতায় কীভাবে স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়ন হবে—এমন প্রশ্নে কমিশনের একজন সদস্য জানান, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়াতে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হবে। সচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রিমিয়াম (কিস্তি) নেওয়া হতে পারে। সামাজিক বিনিয়োগ, সোশ্যাল বিজনেসের (সামাজিক ব্যবসা) জন্য বিনিয়োগকারীদের উদ্বুদ্ধ করা হতে পারে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নিজ উদ্যোগে কাজ করত। সে ক্ষেত্রে সরকারের কোষাগারে তারা লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশ জমা দেবে। তা থেকে জটিল চিকিৎসায় ব্যয় হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, একটি দেশের স্বাস্থ্য-ব্যয়ের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সেবাগ্রহীতার নিজের পকেট থেকে যেতে পারে। স্বাস্থ্যের জন্য সরকারের ব্যয় জিডিপির ৫ থেকে ৬ শতাংশ হতে হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৫ দশমিক ২ শতাংশ, যা জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। ডব্লিউএইচওর সর্বশেষ হিসাব বলছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ছিল জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশ।

স্বাস্থ্যবিমা নিয়ে সংস্কার কমিশনের চিন্তাকে ইতিবাচক বলছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা। তবে বিমা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে পরিকল্পনা থাকতে হবে বলে মনে করেন তাঁরা। তাঁরা বলছেন, সরকার একটি জাতীয় স্বাস্থ্য তহবিল গঠন করতে পারে। যেখানে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সবার কাছ থেকে দৈনিক এক টাকা বা তার কম কেটে নেবে। অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার, তামাক পণ্যসহ অতি বিলাসী পণ্য থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের বিশেষ কর আদায় করে ওই তহবিলে রাখা উচিত। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী সরকার চিকিৎসাবিমায় খরচ করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কীভাবে স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়ন হবে, তার স্পষ্ট উল্লেখ কমিশনের প্রতিবেদনে থাকতে হবে। রোগের সংখ্যা প্রাথমিকভাবে কম, তাতে সমস্যা নেই। দেশে স্বাস্থ্যবিমা চালু করা কঠিন। কেননা, মাত্র ১২-১৩ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। বাকিরা আয় করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে। তাঁদের কাছ থেকে কীভাবে বিমার প্রিমিয়াম নেওয়া হবে? এসব বহনের সক্ষমতা সরকারের নেই। কেউ প্রিমিয়াম দিয়ে বিমার সুবিধা নিলে তেমন বিমা তো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। তিনি বলেন, বিমার সুবিধায় স্বাস্থ্যসেবা কোন প্রতিষ্ঠান, কীভাবে দেবে, তার উপায় থাকা উচিত। জাতীয় স্বাস্থ্য তহবিল ছাড়া সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।