Image description
 
দেশের শিল্পকারখানাগুলোতে হঠাৎ করেই গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে চলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আরো প্রকট হচ্ছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন শিল্প উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকরা। বিশেষ করে যারা যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত স্থগিত হওয়ায় বিপুল পরিমাণ রপ্তানি আদেশ নিয়েছিলেন, তাদের কপালে অনিশ্চয়তার ভাঁজ পড়েছে।
 
 
জানা গেছে, গ্যাস ব্যবহার করে ছোটবড় কারখানাগুলো নিজস্ব উদ্যোগে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। জ্বালানি হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো তেলও ব্যবহার করে। তবে খরচ কম হওয়ায় অধিকাংশ জেনারেটর চলে গ্যাসে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে চলা প্রকট গ্যাস সংকটে দেশের রপ্তানিনির্ভর ও অভ্যন্তরীণ বাজারভিত্তিক বহু কারখানায় আংশিক অথবা সম্পূর্ণরূপে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।
 
এই সংকটের ভয়াবহতা এমন এক সময়ে দেখা দিয়েছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত তিন মাসের জন্য স্থগিত করায় বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক ক্রয়াদেশ পাওয়া যাচ্ছিল। জ্বালানি স্বল্পতার কারণে সময়মতো এসব কার্যাদেশ বুঝিয়ে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
 
চাহিদার আলোকে গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে উৎপাদন নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি পাঠিয়েছে রপ্তানি খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান নোমান গ্রুপ। আরো কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপের পক্ষ থেকেও সরকারের কাছে উদ্বেগ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, পতিত শেখ হাসিনা সরকারের ব্যাপক লুটপাট ও কমিশন বাণিজ্যের কারণে জ্বালানি খাতের সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। উল্টো বিদ্যুৎ আমদানি এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারের নামে দলকানা ব্যবসায়ী ও অনুগতদের অর্থলুটের সুযোগ করে দেওয়া হয়। সেসব অনিয়ম-দুর্নীতির খেসারত দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ খাতকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেছে।
 
শিল্পকারখানাগুলোতে গ্যাস সংকট নতুন কিছু নয়, বছরের পর বছর এ পরিস্থিতি চলছে। তবে ১৫ দিন ধরে যে সমস্যা দেখা যাচ্ছে এর অন্যতম কারণÑ বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন বাড়াতে শিল্পকারখানাগুলোতে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া। এর মধ্যে শুধু তিতাস নেটওয়ার্কেই শিল্পখাতে দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমেছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন খাতে ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে।
 
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ যেখানে ২৭০ থেকে ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট ছিল, বর্তমানে তা ৩৮০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যেমন ৯ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ২৭৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ঘনফুট। এদিন সার কারখানার জন্য গ্যাস বরাদ্দ ছিল ২ দশমিক ২ মিলিয়ন ঘনফুট। একই দিনের হিসাবে শিল্পকারখানা, সিএনজি স্টেশন ও আবাসিক কাজের জন্য গ্যাস বরাদ্দ ছিল এক হাজার ২৭৮ দশমিক ৯ মিলিয়ন ঘনফুট।
 
গত ২০ এপ্রিল শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ করা হয় ৩৪৩ দশমিক ১ মিলিয়ন ঘনফুট। এদিন সার উৎপাদনে বরাদ্দ ছিল ৭২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এ সময়ে শিল্পকারখানা, সিএনজি স্টেশন ও আবাসিক কাজের জন্য গ্যাস বরাদ্দ ছিল এক হাজার ১৬৯ মিলিয়ন ঘনফুট।
 
নোমান গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বর্তমানে তিন ক্যাটাগরিতে গ্যাস সরবরাহের তথ্য দিচ্ছে। এগুলো হলোÑ বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার উৎপাদন ও শিল্পসহ আবাসিক খাত। শিল্পকারখানাসহ আবাসিক খাতের বরাদ্দ কমিয়ে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। এতে শিল্পকারখানাগুলো মারাত্মক গ্যাস সংকটে পড়েছে।
 
তিনি জানান, দৈনিক এক হাজার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস শিল্পকারখানা, সিএনজি স্টেশন ও আবাসিক খাতের কোটায় বরাদ্দ থাকলে উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট থাকে না। তবে গ্রীষ্ম মৌসুম মাথায় রেখে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোয় সার উৎপাদনে বিকল্প হিসেবে আমদানির বিষয়টি বিবেচনায় নিলে শিল্পকারখানার সংকট এত প্রকট হতো না।
 
উদ্যোক্তারা বলছেন, এই মুহূর্তে রপ্তানিমুখী শিল্পে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখা জরুরি। তারা প্রস্তাব দিয়েছেন, সার উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত গ্যাস কিছুটা কমিয়ে তার পরিবর্তে প্রয়োজন হলে সার আমদানির বিকল্প ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বাজার থেকে আসা ক্রয়াদেশগুলো সময়মতো সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
 
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে অনেক নামকরা কারখানা আংশিকভাবে চালু রয়েছে। মীর সিরামিকস চলছে মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে। সিআরসি টেক্সটাইল ২০ শতাংশ, আমান টেক্সটাইল ৪০ শতাংশ, হ্যামস গার্মেন্টস ৪৫ শতাংশ, গ্রেটওয়াল সিরামিকস ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ, সোমার সিএনজি ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ, মাহমুদ ডেনিমস ১০ থেকে ১৫ শতাংশ, সাদমা ফ্যাশন ১৮ থেকে ২০ শতাংশ, তালহা ফেব্রিকস লিমিটেড ২৫ শতাংশ সক্ষমতায়, জুবায়ের স্পিনিং মিলস লিমিটেড ৩৫ শতাংশ, নোমান স্পিনিং মিলস লিমিটেড ৬০ শতাংশ, নোমান কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেড ৬৫ শতাংশ, বাদশা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড ৬৫ শতাংশ, স্কয়ার টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড ৬০ শতাংশ, তালহা স্পিনিং মিলস লিমিটেড ৭০ শতাংশ এবং নরিশ পোলট্রি ফিড অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড মাত্র ১০ শতাংশ উৎপাদন চালু রেখেছে।
 
শিল্পমালিকরা সরকারের কাছে দ্রুত ও টেকসই সমাধানের দাবি জানিয়েছে। অন্যথায় বিদ্যমান ক্রয়াদেশগুলো বাস্তবায়নে ব্যর্থতা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার বাইরে ঠেলে দিতে পারে।
 
এদিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রমবর্ধমান সংকট মেটাতে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ চলতি বছরেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত ৩৪টি গ্যাসকূপ খনন, অনুসন্ধান, উন্নয়ন এবং ওয়ার্কওভারের পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব কূপে উৎপাদন বাড়লে এলএনজি আমদানির চাপও কমবে।
 
জানা গেছে, কূপ খনন ও ওয়ার্কওভারের কারিগরি বিশ্লেষণ ও অগ্রাধিকার নির্ধারণের জন্য পাঁচ সদস্যের উপকমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি যে কূপ যেভাবে খনন ও উন্নয়নের পরামর্শ দেবে, কোম্পানিগুলো সেভাবে তা বাস্তবায়ন করবে।
 
পেট্রোবাংলা জানায়, প্রতিনিয়ত দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। সেটা এলএনজি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। প্রতি ইউনিট (এমএমসিএফডি) এলএনজিতে দাম পড়ে ৭০ থেকে ৭১ টাকা। আর প্রতি এমএমসিএফডি দেশে উত্তোলিত গ্যাসের দাম পড়ে চার টাকা। এজন্য ব্লেন্ডেড প্রাইস হয় ২৪ টাকার সামান্য বেশি। তবে শিল্প ও বাণিজ্য খাতে ৩০ দশমিক ৫০ টাকা বা ৩১ দশমিক ৫০ টাকা দর নিয়ে পেট্রোবাংলা পায় কমবেশি ২২ টাকা।
 
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সূত্র জানায়, শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ অনেক কমে গেছে। যেখানে একটি শিল্প ইউনিটের জন্য স্বাভাবিকভাবে ১০ পিএসআই গ্যাস বরাদ্দ থাকে, সেখানে এখন ১ পিএসআই-ও মিলছে না।
 
এ বিষয়ে বিটিএমএর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্তে ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করা দেশীয় শিল্পের জন্য বড় সুসংবাদ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ সুখবর পাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই গ্যাস সংকট চরমে পৌঁছেছে। এখন অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পথে।
 
গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আমার দেশকে বলেন, সরকার এলএনজি আমদানির মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। খুব শিগগিরই ঘাটতির কিছুটা পূরণ হবে। ফলে শিল্পখাতে গ্যাস সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাবে।