Image description
 

রাতের অন্ধকারে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলরাশি থেকেই শুরু হয় এই গল্প। পাথরঘাটার এক জেলে নৌকার ভাঙা ট্রান্সমিটার থেকে শেষ যে বার্তাটি এসেছিল, তা ছিল জীবন-মরণের আকুতি - "আম্মা দোয়া কইরো"। তারপর নিঃশব্দে সাগরের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল পাঁচটি প্রাণ। এই করুণ দৃশ্য বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষের দৈনন্দিন বাস্তবতা। কিন্তু এখন তাদের চোখ আকাশে তাকায় অন্য এক আশায় - স্টারলিংকের স্যাটেলাইট সিগনালের সন্ধানে।  

২০২৫ সালে বাংলাদেশের ডিজিটাল ভূগোলে যুক্ত হলো নতুন মাত্রা। স্পেসএক্সের স্টারলিংক সেবা চালুর অনুমোদন পাওয়ার পর থেকেই বদলে যেতে শুরু করেছে উপকূলীয় মানুষের জীবনচিত্র। ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে প্রথম প্রদর্শনীতে যখন ২০০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট দেখা গেল, তখন উপস্থিতদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া - কেউ উচ্ছ্বসিত, কেউবা শঙ্কিত। কারণ এটি ছিল শুধু প্রযুক্তির উৎকর্ষেরই নয়, বরং সমাজে ক্ষমতার নতুন সমীকরণেরও ইঙ্গিতবাহী।  গাইবান্ধার এক তরুণ ফ্রিল্যান্সার, যে কদিন আগেও 'নেট নাইট' শব্দটির সাথে যুদ্ধ করত, এখন মহাকাশের স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের সাথে সংযুক্ত। কিন্তু এই প্রযুক্তি এখনও সবার নাগালের বাইরে। পটুয়াখালীর এক জেলের প্রশ্ন: "একটা কিটের দাম যেখানে আমার বছরের আয়, সেখানে এই স্বাধীনতা কি আমার জন্য?"

 

তবে স্টারলিংকের সম্ভাবনা অস্বীকার করার নয়। হারিকেনের পূর্বাভাস থেকে শুরু করে দূরবর্তী চিকিৎসা পরামর্শ - সবই এখন সম্ভব হচ্ছে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের 'জেলে ডিজিটাল নেটওয়ার্ক' উদ্যোগের মাধ্যমে প্রথম স্টারলিংক কিট বসানো হয়েছে একটি ট্রলারে। এখন জেলেরা সাগর থেকে সরাসরি পরিবারকে জানাতে পারে: "আব্বা, আজ মাছ কম পাইছি, কিন্তু ঝড়ের খবর পাইয়া ফিরতেছি।"  

এই প্রযুক্তি স্থানীয় ইন্টারনেট সেবাদাতাদের জন্য তৈরি করছে অস্তিত্বের সংকট। ঢাকার এক আইএসপি মালিকের কথায়: "আমরা যারা দেশে ইন্টারনেট বিস্তারে কাজ করেছি, আজ আমাদেরই হুমকির মুখে।" প্রশ্ন উঠছে - এই প্রযুক্তি কি আসলেই বাংলাদেশের জন্য, নাকি এটি আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনের নতুন ধরনের ঔপনিবেশিকতা?  

জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত এখানে। স্টারলিংকের মতো স্যাটেলাইট ইন্টারনেটে সরকারের নিয়ন্ত্রণ সীমিত। একদিকে এটি নাগরিকদের গোপনীয়তা রক্ষার সুযোগ দেয়, অন্যদিকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে এর অপব্যবহারের শঙ্কাও তৈরি করে।  

ড. ইউনূসের দৃষ্টিভঙ্গি এখানে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে। তাঁর প্রস্তাবিত 'ডিজিটাল গ্রামীণ সহায়তা তহবিল' সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে প্রান্তিক মানুষের কাছে এই প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে পারে। যেমনটা ক্ষুদ্রঋণ একসময় গ্রামীণ নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল।  

একটি ট্রলারে বসানো স্টারলিংক কিট শুধু ইন্টারনেট সংযোগই দেয় না, এটি উপকূলীয় মানুষের জন্য নিয়ে আসে নিরাপত্তার আশ্বাস। যে বৃদ্ধ একসময় সাগরে হারিয়ে যাওয়া ছেলের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, এখন তিনি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পেয়ে যাচ্ছেন প্রিয়জনের খোঁজ।  বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে প্রযুক্তির এই নতুন জোয়ারে চড়ে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর সুযোগ, অন্যদিকে স্থানীয় শিল্প ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার চ্যালেঞ্জ। ড. ইউনূসের মডেল দেখিয়ে দিচ্ছে, এই প্রযুক্তিকে কীভাবে সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়।  

মহাকাশের স্যাটেলাইট থেকে আসা এই সিগনাল এখন শুধু ডেটা বহন করে না, এটি বহন করে উপকূলীয় মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা। যে জেলেরা একসময় প্রকৃতির রোষাণলে অসহায় ছিল, আজ তারা প্রযুক্তির সাহায্যে লড়াই করছে বেঁচে থাকার জন্য। এটিই বাংলাদেশের নতুন ডিজিটাল গল্প - যেখানে মহাকাশের প্রযুক্তি মিলিত হচ্ছে মাটির মানুষের স্বপ্নের সাথে।