
বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্রে, একদা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি)-এর মতো মানবিক সহায়তা সংস্থা, যা মানবিকতার আলোকবর্তিকা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত স্বৈরাচারি সরকারের সময় থেকে তা ধীরে ধীরে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে।
এই সংস্থার বাংলাদেশ কান্ট্রি ডেলিগেশনটি এখন রাকিবুল আলম ও মালিহা ফেরদৌস নামক দুই ব্যক্তির শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে।
রাকিবুল আলম, প্রোগ্রাম সাপোর্ট-এর সিনিয়র ম্যানেজার এবং মালিহা ফেরদৌস, জলবায়ু কার্যক্রম, স্থিতিস্থাপকতা ও পিআরডি-এর প্রধান। গত ১৮ বছর ধরে তারা নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের কল্যাণের নামে প্রতি মাসে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকারও বেশি বেতন নিচ্ছেন। তাদের নিয়োগকৃত লোকজন দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করছে, যেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কোনো স্থান নেই।
রাকিবুল আলম
এই সিন্ডিকেটের নিয়োগকৃত লোকজন দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। যদিও আইএফআরসি দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির জন্য বাংলাদেশের কান্ট্রি ডেলিগেশনে রাকিবুল আলম এবং মালিহা ফেরদৌস পদত্যাগ করলেও পার্টনার ন্যাশনাল সোসাইটি (পিএনএস) ও সিন্ডিকেট এবং ভারতীয় কর্মচারীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
ভারতীয় কর্মচারীরা আইএফআরসির শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে, যা বাংলাদেশিদের জন্য কাজের সুযোগ ক্রমশ সীমিত করে দিচ্ছে।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন জানা যায় যে, পার্টনার ন্যাশনাল সোসাইটি (পিএনএস) ও সিন্ডিকেট এবং ভারতীয় কর্মচারীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ভারতীয় কর্মচারীরা আইএফআরসির শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে, যা বাংলাদেশিদের জন্য কাজের সুযোগ ক্রমশ সীমিত করে দিয়েছে।
মালিহা ফেরদৌস
এই রকম এক পরিস্থিতিতে হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর আইএফআরসি সাহসী মানুষদের প্রচেষ্টায়, ধীরে ধীরে আইএফআরসির দুর্নীতিগ্রস্ত কার্যক্রমের পর্দা উন্মোচিত করা হয়। দাতা সংস্থাগুলো তাদের অনুদান বন্ধ করে দেয় এবং আইএফআরসির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অবশেষে, রাকিবুল আলম ও মালিহা ফেরদৌসের সিন্ডিকেট ভেঙে যায় এবং তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
তবে মালিহা ফেরদৌস ও রাকিবুল আলমের দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট ও স্বজনপ্রীতি প্রতিষ্ঠানটিকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খেয়েছে। তারা তাদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।
মানব সম্পদ বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে তারা তাদের আত্মীয়-স্বজন ও পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিয়েছে। অসহায় মানুষের উন্নয়নের কথা বলে অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফরে প্রকল্পের টাকা ব্যবহার করা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ে ম্যানেজমেন্ট বিলাসবহুল জীবনযাপন করছিল এবং প্রতি বছর বৈঠক ও ফোরামে যোগদানের নামে বিদেশ ভ্রমণ করেছিল।
সোনাক্ষী দে
মালিহা ফেরদৌস আমেরিকান রেড ক্রস দখল করে রেখেছিলেন এবং তিনি তার ইচ্ছানুযায়ী নিয়োগ করেছিলেন। একই ঠিকাদাররা এই দুই সিন্ডিকেটের লোকের স্বার্থ পূরণ করে কাজ পেয়েছে।
আইএফআরসি বাংলাদেশ কান্ট্রি অফিসে ভারতীয় আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছিল। সোনাক্ষী দে, হৃষিকেশ হরিচন্দন, রঞ্জন মোহন্ত এবং গৌরব রায়ের মতো ভারতীয় কর্মকর্তারা শীর্ষস্থানীয় পদে নিযুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের জন্য ভারতীয় কর্মচারীদের খরচের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। তারা গুলশান, বনানীর মতো এলাকায় বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন এবং চব্বিশ ঘণ্টা যানবাহন সহায়তা পেতেন।
আইএফআরসির প্রতিটি বিষয় ভারতীয় কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রতি মাসে তারা বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা ভারতে নিয়ে যেতেন, সাথে ছিল অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ।
হৃষিকেশ হরিচন্দন
প্রভাস প্রকল্পে লুটপাট ও ইন্টেগ্রেটেড ফ্লাড রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম (আইএফআরপি) প্রকল্পে দুর্নীতির মতো ঘটনাগুলো আইএফআরসির দুর্নীতিগ্রস্ত স্বরূপকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। প্রকল্পের বেশির ভাগ অর্থ মালিহা ফেরদৌস ও রাকিবুল আলম আত্মসাৎ করেছে।
আইএফআরপির মতো প্রকল্পগুলোতেও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, যেখানে কর্মীদের বেতন অস্বাভাবিকভাবে বেশি ছিল এবং প্রকল্পের মোট বাজেটের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ কর্মচারীদের বেতন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
নিয়োগ স্বচ্ছতার অভাব ও আইএফআরসির কোনো বাহ্যিক নিরীক্ষা বা অডিট না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতিগ্রস্ত কার্যক্রম আরও সহজ হয়ে যায়। দাতা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তহবিল তাদের ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করা হচ্ছিল, যেখানে কোনো জবাবদিহিতা ছিল না।
গৌরব রায়
আইএফআরসির সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট ও বিদেশি প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও দরিদ্রদের সহায়তার নামে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। দাতার টাকা থেকে তারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করেছিলেন। বিলাসবহুল যানবাহন, হোটেল, এয়ার-সুবিধা এবং অন্যান্য গোপন সুবিধা তাদের জীবনযাত্রাকে আরও আরামদায়ক করে তুলেছিল।
আইএফআরসি সংস্থার বাংলাদেশ কান্ট্রি ডেলিগেশনের প্রধান রাকিবুল আলমের সাথে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।