Image description

Farjana Mahbuba (ফারজানা মাহবুবা)


নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে- “যৌন পেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা এবং শ্রম আইনে একে স্বীকৃতি" দিতে হবে। - আসেন দেখি এতে সমস্যা কোথায়।
বাংলাদেশ সহ গ্লোবাল সাউথের এবং পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলোর প্রায় সব দেশেই (এমনকি উন্নত দেশেও) যৌনপেশা একটা মডার্ন স্লেইভারী। এটা এমন একটা ইন্ডাষ্ট্রী যে ইন্ডাষ্ট্রী পুরোটাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে structural coercion এবং নারী নির্যাতনের উপর।
ওয়েস্টে এখন মডার্ন স্লেইভারীর উপর যত গবেষণা হচ্ছে- অলমোষ্ট সব গবেষণাতেই বলছে পৃথিবী জুড়ে সেক্স-ইন্ডাষ্ট্রীতে মেয়েদেরকে রিক্রুট করা হয় তিনটা পদ্ধতিতেঃ
ম্যানিপুলেশান,
কোয়েরশান (জোড় করে/ ফোর্স করে/ বাধ্য করে/ নির্যাতন করে),
আর ডিসিপশান (ধোঁকা দিয়ে)।
আপনি যখন যৌনপেশাকে স্বীকৃতি দিতে বলছেন, আপনি এই মডার্ন স্লেইভারীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা ইন্ডাস্ট্রিকে আইনগত বৈধতা দিতে বলছেন।
আমি অস্ট্রেলিয়ান স্কলার শেইলা জাফ্রিস'র কথা বলেছিলাম। উনি ডিরেক্টলি বলেছেন- সেক্স ওয়ার্ককে লীগালাইজ করতে বলা আসলে স্লেইভারীকে লীগালাইজ করতে বলা সেইম কথা।
কারণ লজিকটা সেইম- আপনি একজন মানুষকে লীগাল রাইট দিচ্ছেন আরেকজন মানুষের শরীরের উপর; এবং আপনি সেই শরীরের প্রাইজ নির্ধারন করছেন। এক্সেক্টলি যা স্লেইভারীকে জাষ্টিফাইড করতে করা হতো।
সেক্স ইন্ডাস্ট্রিতে মেয়েদের শরীর একটা পণ্য। ক্যাপিটালিষ্ট বা ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সবকিছুকে পণ্য হিসেবে এর ভ্যালু নির্ধারন করা হয়। এই কমিটি আইনি বৈধতা চাচ্ছে মেয়েদের শরীরকে পণ্য হিসেবে ট্রীট করতে।
আপনি যখন একটা মেয়ের শরীরকে আইনগতভাবে পণ্য হিসেবে কিনতে পারবেন, তখন আপনি এই পণ্যের সাথে যা ইচ্ছা তা করতে পারবেন- কারণ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আপনি টাকার বিনিময়ে এই শরীর কিনে নিয়েছেন।
এখানে ধর্মকে যদি বাদও দেন, (এই কমিটি বলেছে ধর্ম মেয়েদের জন্য সবচে' বড় বাঁধা, তাই ধর্মকে বাদ দিচ্ছি), তারপরও অনেকগুলো ডিলেমা আছে-
মানুষ কি তার নিজের শরীরকে কমোডিটি হিসেবে ট্রীট করতে পারবে কিনা?
একাডেমিয়াতে এই প্রশ্নটাকেই এখন এভাবে জিজ্ঞেস করছে-
Are there some things money SHOULDN'T buy?
Should everything that can be sold, be sellable?
এই কমিটি এইসমস্ত একাডেমিক এবং ফেমিনিষ্ট বিতর্কগুলোকে পাশ কাটিয়ে ডাইরেক্ট সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছে- নারীর শরীরকে পণ্য হিসেবে বেচাকেনা করার আইনি অধিকার দিতে হবে!
অথচ ফেমিনিজমের মূলধারার একটা বিতর্ক হলো- যৌনপেশা কোনো ফ্রীডম বা স্বাধীনতা না, নারীর শরীরকে পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পুরুষের আধিপত্যকেই আসলে বৈধতা দেয়া। The Sexual Contract বইয়ে খুব চমৎকারভাবে বলা হয়েছে- 'To sell sexual use of the body is to sell the person'.
যৌনপেশায় জড়িত নারীদের কতজন কোনো ধরণের স্ট্রাকচারাল ইনফ্লুয়েন্স ছাড়া, ইন্টারসেকশনাল ভলনারেবিলিটির শিকার না হয়ে, সম্পূর্নভাবে নিজের ইচ্ছায় এ পেশায় আসে?
এ পেশায় নারী কি 'আসে' নাকি 'আসতে বাধ্য হয়'? নারীর 'যৌন' শ্রমকে বুঝতে হলে শুধু 'সম্মতি'/কনসেন্ট বুঝলেই কি হবে? নাকি যত রকমের স্ট্রাকচার আছে সমাজে, রাষ্ট্রে, আইনে - এগুলোকেও বিবেচনায় আনতে হবে?
ক্যাথরিন ম্যাকিননের কথা বলেছিলাম; উনি লিখেছেন কীভাবে দারিদ্রটা, স্ট্রাকচারাল অপ্রেশান, জেন্ডার ভায়োলেন্স, সামাজিক সেক্সিজম, রাষ্ট্রীয় ব্যার্থতা- এগুলো সব মেয়েদের জন্য অনেক সময় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে বা নিতে বাধ্য হতে 'কনসেন্ট' ম্যানুফেকচার করে। 'কনসেন্ট' মানেই যে ফ্রীডম না।
দারিদ্রতা, মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব, পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতার স্বীকার নারী আদৌ কতটা স্বাদীনভাবে 'চয়েজ' করতে পারেন যৌন পেশাকে পেশা হিসেবে নিতে?!
যখন আপনি বলছেন সেক্স-ইন্ডাস্ট্রিকে আইনি বৈধতা দিতে হবে, আপনি এই মেয়ে/মহিলাগুলো কেনো সেক্স ইন্ডাস্ট্রিতে আসতে বাধ্য হয়েছে/হচ্ছে তা জিজ্ঞেস না করে উল্টো বলছেন- এই যে আসছে, এটাকে বৈধতা দিতে!
আপনি ভায়োলেন্স থামাতে বলছেন না, আপনি বলছেন ভায়োলেন্স যে হচ্ছে তা আইনগতভাবে করা হোক!
আপনি বলছেন যৌন কর্মীরা যেহেতু অলরেডী আছে, তাই বৈধতা দিতে হবে; মানে হলো- মানুষ চুরি যেহেতু করেই, তাই চুরি করাকে আইনগতভাবে বৈধতা দেয়া হোক! মানুষ বৌকে যেহেতু মারেই, তাই এই মারামারিকেও তাহলে আইনগতভাবে বৈধতা দেয়া হোক! -
কারণ বাংলাদেশে যত স্টাডিজ আমি ঘেঁটেছি সবজায়গায় বলছে বাংলাদেশে বউকে মারার হার অলমোষ্ট ৫০% বা তার চেয়ে বেশী!
আপনি যে যুক্তিতে সেক্স ইন্ডাস্ট্রিকে আইনগত বৈধতা দিতে বলছেন, সেইম যুক্তিতে যেহেতু বাংলাদেশে প্রতি দুইজনে একজন জামাই তার বউকে মারে, তাহলে এটাকে কেনো নরমালাইজড করা হবে না?
আমার কাছে এই বিষয়ে নারী কমিশনের যে কথাটা সবচেয়ে ভয়ংকর লেগেছে তা হলো- নারী কমিশন তাদের রিপোর্টে দাবী করেছে - “জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার নামে যৌনকর্মীদের পেশাকে নিরোধ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন”।
জনস্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলছিনা কারণ সেক্সওয়ার্কের সাথে পাবলিক হেলথ এর ইন্টারসেকশান নিয়ে আমার পড়ালেখা নাই তেমন, কিন্তু যেভাবে রিপোর্ট বলছে "নৈতিকতার নামে" যদি কাউকে যৌনকর্মী হতে বাঁধা দেয়া হয় তা হিউম্যান রাইটস'র ভায়োলেশান;
তাহলে রাস্তায় কেউ যদি বলে আমি উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো- সেই রাইটসও আপনার তাকে দিতে হবে। ইন ফ্যাক্ট কেউ যদি বলে আমি রাস্তায় সবার সামনে সেক্স করবো- তাকে সেই রাইটসও আপনার একই যুক্তিতে দিতে হবে!
কারণ যখন 'নৈতিকতা' বা একটা সমাজের এথিক্যাল ভ্যালুজকে আপনি সরিয়ে দিচ্ছেন-
তখন উলঙ্গ হয়ে থাকা বা প্রকাশ্যে সেক্স করতে না দেয়াটা কেনো মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না?
যে দেশগুলোকে সেক্যুলার লিবারাল রাষ্ট্র বলা হয়, সেখানেও পাবলিক ডিসেন্সি আইন, হেইট স্পীচ, অবসেনিটি আইন, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক আইন আছে যা ঐ রাষ্ট্রগুলোর সমাজের নৈতিক ভ্যালুজের উপর প্রতিষ্ঠিত।
আমি এজন্যেই বলি, ডেকচির চেয়ে ঢাকনা গরম- বাংলাদেশের সেক্যুলাররা, বিশেষ করে নারীবাদী সেক্যুলাররা এক অদ্ভুত কিসিমের সেক্যূলারিজমের কথা বলে যা কিনা খোদ ওয়েস্টে প্রশ্নবিদ্ধ!
আইন তখনই সোশাল মোরালিটি/এথিক্স বা নৈতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়যখন তা মানুষের ডিগনিটি অথবা ইক্যুয়ালিটিকে চ্যালেঞ্জ করে।
কিন্তু সেক্স ওয়ার্ক একেতো নারী নির্যাতনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার, নারীদেরকে মডার্ন স্লেইভ বানায়; অন্যদিকে হিউম্যান ডিগনিটিকে সম্পূর্ণভাবে কবর দিয়ে দেয়।
আপনি আপনার শরীর বিক্রি করবেন- আপনার প্রাইভেট পার্টসকে ভাড়া দিবেন- এটা পৃথিবীর কোনো সমাজ, রাষ্ট্র, কমিউনিটি, গোত্র, গ্রুপ কেউ আজ পর্যন্ত বলেনি 'আ ডিগনিফাইড ওয়ে টু আর্ন মানি'। কেউ বলেনি।
আমি বলেছি ধর্ম দিয়ে যুক্তি দিবো না। তাই ওয়েষ্টার্ন স্কলারদের কথা থেকেই বলি- বৃটিশদের কোডিফাই করে দেয়া মুসলিম পারিবারিক আইন নিয়ে ঘাটতে গিয়ে দেখেছি- মুসলিমদেরকে তাদের শরীয়াহ আইন দিয়ে শাসন করতে দেয়ার (পলিটিক্যাল কারণটা বাদ দিয়ে) অন্যতম একটা কারণ ছিলো-
ওয়েষ্টার্ন স্কলাররা বলছেন-
A law that does not respect the values of the society is not mere unjust, it is dysfunctional.
আইন নিয়ে পড়তে গেলেই খুব কমন কিছু ফ্রেইজ দেখা যায়ঃ পাবলিক'স মোরাল কনভিকশান, কালচারাল এন্ড রিলিজিয়াস সেনসিটিভিটি, সোশাল লেজিটিম্যাসি, মোরাল ফেব্রিক অফ সোসাইটি, শেয়ার্ড এথিক্যাল ভ্যালুজ... ইত্যাদি ইত্যাদি।
এগুলো কী?
এগুলো আইনের ভাষায় সমাজের নৈতিকতাকে একটা মানদন্ড হিসেবে কন্সিডার করা। আইন আমার পড়ালেখার ফিল্ড না, কিন্তু রিসার্চের প্রয়োজনে যতটুকু পড়তে হয়েছে তাতেই দেখতে পাচ্ছি- খোদ সেক্যুলার আইনেই বার বার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে কীভাবে মেজরিটি মানুষদের এথিক্যাল বিলিভসকে ইগনোর করলে তা আইনের সোশাল লেজিটিম্যাসিতে ইফেক্ট করে এবং আলটিমেটলি তা আইনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে।
আর এই রিপোর্ট কী বলছে?? - আইন করতে হবে বাংলাদেশে নৈতিকতার নামে কাউকে নাকি যৌনকর্মী হতে বাঁধা দেয়া যাবেনা! যদি বাঁধা দেয় তা নাকি মানবাধিকারের লঙ্ঘন!
আরো অনেক কথা আছে। এত কথা শেষ হবে না। একটা কৌতূহল শুধু বলি- এই যে কমিটি- এই কমিটির মহিলাদের কারো নিজের মেয়ে যদি ম্যানিপুলেশান, কোয়েরশান বা ডিসিপশানের শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে গিয়ে ঠাঁই পেতো, তখন সেই মেয়ের মা হিসেবে উনারা কী চাইতেন?
যৌনপল্লীকেই বৈধতা দিয়ে দেয়া হোক (যাতে উনার মেয়ের মত আরো মেয়ে ঐখানে যেতে বাধ্য হয়)?
নাকি জীবন মরণ দিয়ে সেক্স-ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতেন? রাষ্ট্রকে বলতেন বর্তমানে যারা এই সেক্স ইন্ডাস্ট্রিতে থাকতে বাধ্য হচ্ছে তাদের প্রত্যেককে ডিগনিফাইড ওয়েতে পূনর্বাসন করতে হবে এবং ভবিষ্যতে যেন একটা সিংগল মেয়ে/মহিলাও সেক্স ইন্ডাষ্ট্রীর বলি হয়ে মডার্ন স্লেইভ হতে বাধ্য না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে?
কোনটা?