
১০ দিনের মধ্যে দুটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার ভিডিও ফাঁসে বিপাকে পড়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। আলোচিত ঘটনা দুটি হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ পোড়ানো এবং সর্বশেষ প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পারভেজ হত্যার ঘটনা।
ডিএমপি বলছে, দুই ঘটনায় গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি-পরিচয় প্রচার ও ভিডিও ফাঁস হওয়ায় আসামিরা লাপাত্তা। সর্বাত্মক চেষ্টা স্বত্ত্বেও আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারছে না পুলিশ।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সন্দেহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ‘আনন্দ শোভাযাত্রার’ জন্য তৈরি করা আলোচিত মোটিফ ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত যুবক দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। যদিও গত ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রার শুরুর আগেই তাকে গ্রেপ্তারের সুখবর দিতে চেয়েছিল ডিএমপি।
গত রোববার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে নববর্ষের নিরাপত্তা ব্রিফিংয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছিলেন, ‘আমরা কোনো মামলা তদন্তের আগে কোনো কথা বলি না। তবে এ ঘটনায় আমরা অত্যন্ত ক্লোজ। এ মামলা তদন্ত ও জড়িতকে শনাক্তে আমরা খুব নিকটে পৌঁছে গেছি। আমরা আশা করছি শোভাযাত্রার শুরুর আগেই একটা সন্তোষজনকভাবে মামলাটা ডিটেকশন করতে পারব। এর মধ্যে আমরা যথাসম্ভব জড়িত দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ।’
ডিএমপির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। গোয়েন্দারা কাজ করছেন। কিন্তু সন্দিগ্ধ সেই যুবককে গ্রেপ্তারে কোনো সুখবর আজও নেই।
গত ১২ এপ্রিল ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নববর্ষের ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ উপলক্ষ্যে বানানো আলোচিত মোটিফ ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’সহ ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফের একাংশও আগুনে পোড়ানো হয়। এ নিয়ে শাহবাগ থানায় একটি মামলাও হয়।
‘ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতিতে’ আগুন দেওয়ার ঘটনায় সিসিটিভি ভিডিওতে মাস্ক পরা যে যুবককে দেখা গেছে, তিনি আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগ কর্মী বলে ওই বিভাগের শিক্ষার্থীদের ধারণা।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মুনসুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে মামলাটি এখন তদন্ত করছে ডিবি ওয়ারী বিভাগ। আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে এখনো কোনো সুখবর নেই।’
গোয়েন্দা ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মোস্তাক আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা মামলা তদন্ত করছি। এখনো সন্দেহভাজন সেই যুবককে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। সে দেশে নাকি দেশের বাইরে সেরকম কোনো তথ্য আমরা এখনো বের করতে পারিনি। হয়ত আরও সময় লাগবে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) এস এন মো. নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তো ওকে (সন্দিগ্ধ যুবক) নজরদারিতেই রেখেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে আগুন দেওয়ার ভিডিওটা ছেড়ে দেওয়ার পর ওই যুবক আর নাই। নাই মানে মোবাইল ফোন বন্ধ, আর অন করেনি।
‘আমরা সর্বশেষ তার লোকেশন পেয়েছিলাম গোপালগঞ্জে। এরপর থেকে বন্ধ মোবাইল। সে পালালো কি না, ধারণা করা হচ্ছে সে দেশের বাইরে পালিয়েছে। আমরা ওই যুবকের আগুন দেওয়ার ঘটনার ভিডিও ফাঁস করিনি। বরং বিষয়টি যাতে ফাঁস না হয় সে চেষ্টাই করা হয়েছে।’
অন্যদিকে, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম পারভেজ (২৪) খুনের ঘটনাতেও ভিডিও ফাঁসের পর লাপাত্তা হয়ে গেছে মূল আসামিরা।
গত শনিবার (১৯ এপ্রিল) মিডটার্ম পরীক্ষা শেষে বিকেল ৩টায় পারভেজ বন্ধু তরিকুল, সুকর্ণ, ইমতিয়াজসহ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে র্যানকন বিল্ডিংয়ের সামনে একটি পুরি-শিঙাড়ার দোকানে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল ও হাসাহাসি করছিল। তাদের পেছনেই দাঁড়ানো ছিল ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সের দুজন ছাত্রী। পারভেজদের হাসাহাসির কারণ জানতে আসে মেহেরাজ ইসলাম (২০), আবু জহর গিফফারি পিয়াস (২০) ও মাহাথির হাসান (২০) নামের তিনজন। তাদের মধ্যে শুরু হওয়া তর্কবিতর্কের বিষয়টি শিক্ষক ও প্রক্টর অফিস পর্যন্ত গড়ায়।
শিক্ষকদের মধ্যস্থতায় বিষয়টি মীমাংসা হওয়ার পরও সন্ধ্যায় হামলার ঘটনা ঘটে। তাতে ছুরিকাঘাতে মারা যান প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম পারভেজ (২৪)।
এ ঘটনায় শনিবার (১৯ এপ্রিল) দিবাগত রাতে নিহতের মামাতো ভাই হুমায়ুন কবীর বাদী হয়ে বনানী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বহিরাগতসহ আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার উল্লিখিত আসামিরা হলেন, মেহেরাজ ইসলাম (২০), আবু জহর গিফফারি পিয়াস (২০), মো. মাহাথির হাসান (২০), সোবহান নিয়াজ তুষার (২৪), হৃদয় মিয়াজি (২৩), রিফাত (২১), আলী (২১) ও ফাহিম (২২)। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ২৫/৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
তিন দিন পার হয়ে গেলেও মূল আসামিদের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। পারভেজ খুনের ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে চার আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন এজহারনামীয় আসামি হৃদয় মিয়াজি। মামলার বাইরের তিনজন হলেন, আল কামাল শেখ ওরফে কামাল (১৯), আলভী হোসেন জুনায়েদ (১৯) ও আল আমিন সানি (১৯)।
পুলিশ জানিয়েছিল, খুনের ঘটনায় মূল আসামিসহ ইন্ধনদাতা হিসেবে কথিত প্রেমিকাকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে খুনের ঘটনার ভিডিও ফাঁসের পর ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সে পড়া ওই কথিত প্রেমিকাসহ লাপাত্তা হয়ে গেছে মূল আসামিরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. আল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রত্যেক আসামিকেই শনাক্ত করা হয়েছিল। আমরা যখন জড়িতদের নাম-পরিচয় ও অবস্থান নিশ্চিত হলাম, তখনই আমরা দেখছি খুনের ঘটনা ও আসামিদের নাম-পরিচয়সহ ভিডিও প্রচার হয়ে গেছে। আমরা আর কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। সবার মোবাইল বন্ধ।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মিডিয়ার কাউকে ভিডিওটা দিইনি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ভিডিওটা ফাঁস হয়ে গেল। এরপর থেকে মূল আসামিরা আনটাচ। কোনোভাবেই তাদের অবস্থান শনাক্ত করা যাচ্ছে না। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’