Image description

আমলাতন্ত্রকে অতিমাত্রায় দলীয়করণের মধ্য দিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে গড়ে তোলা হয় পক্ষপাতদুষ্ট জনপ্রশাসন। তার ওপর ভর করেই দীর্ঘায়িত হয় তাদের শাসনকাল। তাই এ প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে গঠন করা হয় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। নানা বিচার-বিশ্লেষণ শেষে চার মাস পর তাদের প্রতিবেদন জমা পড়ে। সরকারকে জনমুখী করতে জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একগুচ্ছ সুপারিশ দিয়েছে কমিশন। তবে এখনো বৃহৎ পরিসরে সেগুলোর বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি সরকার। এমনকি দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায়নি।

সংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে, সেগুলো ঐকমত্য কমিশনে যাচাই-বাছাই চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গেও চলছে এ নিয়ে আলোচনা। তাদের মতামত নেয়ার পর একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। সে আলোকেই মূলত সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএ ফিরোজ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো জমা দেয়া হয়েছে। এটা নিয়ে ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই তা বাস্তবায়ন করবে সরকার।’

অনুগত আমলাদের পুরস্কৃত করতে আওয়ামী লীগ সরকারের সৃষ্ট পদ ‘সিনিয়র সচিব’ বাদ দেয়ার সুপারিশ রয়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের। তবে সেটি বাদ না দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার উল্টো ঢালাওভাবে ওই পদে নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়, বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন জায়গায়ই সিনিয়র সচিব হিসেবে পদায়ন অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ গত ২৫ মার্চ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান মো. হামিদুর রহমান খান। যদিও এর দুদিন পরই তাকে অবসরে পাঠানো হয়। বর্তমানে সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের বাইরে সিনিয়র সচিব রয়েছেন মোট ১২ জন। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব, বিশেষ সহকারীও সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় চুক্তিভিত্তিক কর্মরত রয়েছেন।

২৫ বছর চাকরির পর সরকারের ইচ্ছায় কর্মীদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর যে বিধান রয়েছে, তা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে। সেটিও আমলে নেয়া হয়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি না করার সুপারিশটিও সরকারের পক্ষ থেকে আমলে নেয়া হচ্ছে না। সচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এরই মধ্যে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অথচ সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে এটি না করার সুপারিশ রয়েছে।

চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় গত ২১ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তপন কুমার বিশ্বাসকে জনস্বার্থে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। এর আগে তিনজন সচিব, ১৭ জন অতিরিক্ত সচিব, একজন যুগ্ম সচিব ও একজন উপসচিবসহ মোট ২২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

এদিকে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ পর্যালোচনায় গঠন করা হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে এ কমিশনের কার্যক্রম পরিচালনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সাচিবিক সহায়তা করছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, জনপ্রশাসন সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এখনো পাওয়া যায়নি। তবে সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের পরই বৃহৎ পরিসরে সে কার্যক্রম শুরু হবে। কমিশনের সুপারিশগুলোকে পরিচালনায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি—এ তিনভাগে ভাগ করা হবে। এর মধ্যে এক থেকে দুই বছরের মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলোকে স্বল্পমেয়াদি, তিন থেকে পাঁচ বছরের মতো লাগতে পারে এমন সুপারিশকে মধ্য এবং পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে যে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হবে, সেগুলোকে রাখা হবে দীর্ঘমেয়াদের জন্য।

জানতে চাইলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের কোনো সুপারিশ যোগ, বিয়োগ কিংবা পরিবর্তন করার এখতিয়ার নেই। সংস্কার কমিশনগুলো যে প্রস্তাব করেছে, তার মধ্য থেকে যেগুলো (১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাব) নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা দরকার সেগুলো রাজনৈতিক দলের কাছে উপস্থাপন করাই ঐকমত্য কমিশনের কাজ। বাকি সংস্কারগুলো সরকার চাইলে বাস্তবায়ন করতে পারে। আমাদের মেয়াদ হলো জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তবে আমরা যত দ্রুত সম্ভব কাজগুলো শেষ করতে উদগ্রীব।’

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পুরনো চার বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত, বিদ্যমান ৪৩ মন্ত্রণালয় ও ৬১ বিভাগকে কমিয়ে যথাক্রমে ২৫ ও ৪০-এ পুনর্বিন্যাস, বিসিএস ক্যাডারগুলোকে ১২টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত এবং পদোন্নতিতে পুলিশ ভ্যারিফিকেশন বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া সব সার্ভিসের মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস)’ গঠন, সিনিয়র সচিব পদ বিলুপ্ত, উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ কোটা কমিয়ে ৫০ শতাংশ করা, ডিসিকে মামলা গ্রহণের ক্ষমতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা পিএসসি, ১৫ বছর চাকরি করলে স্বেচ্ছায় অবসরের সুযোগ, বেতন বাড়ানো ও স্থায়ী বেতন কমিশন, কর্মকর্তাদের দাবি আদায়ে বিক্ষোভ নয়—এমন সব সুপারিশও করেছে সংস্কার কমিশন।

জনপ্রশাসন সংস্কার কার্যক্রমের সবশেষ অবস্থা নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব-উল-আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। গত রোববার কেবিনেটে এ-সংক্রান্ত মিটিং হয়েছে। সব কার্যক্রম কেবিনেট ডিভিশন মনিটরিং করছে। তবে যেসব সুপারিশ এসেছে সেগুলো ঐকমত্য কমিশনের ফাইনাল রিপোর্টের ভিত্তিতেই মূল কার্যক্রম শুরু হবে।’

এদিকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম। সেদিন ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কমিশনের সঙ্গে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের প্রথম বৈঠক হয়। এরপর সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চাওয়া হয়। এর মধ্যে ৩৪টি দল তাদের মতামত তুলে ধরে, যাদের সঙ্গে এখন আলাদা করে বৈঠক করছে কমিশন। এখন পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ ১৫টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর স্ট্রং অপিনিয়ন নেই, সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ সরকার নিতে পারে। এর মধ্যে প্রশাসনিক সংস্কার যেগুলো রয়েছে, যেমন মন্ত্রণালয় বা বিভিন্ন দপ্তরের কাজের পদ্ধতি, নিয়োগ, পদোন্নতি এসব সংস্কার কার্যক্রম সহজেই সম্পন্ন করা সম্ভব। পাশাপাশি যেসব মৌলিক বিষয় রয়েছে, যা নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে সংলাপ চলছে, সেগুলোর সমাধান করে তারপর অন্যান্য সেক্টরাল সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।’