
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ‘কালো বিড়াল’ প্রকৌশলী নূরুল ইসলাম। কেতাদুরস্ত অথচ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন এই কারিগর আমলাকে অনেকে ‘ভেজা বিড়াল’ হিসেবেও চেনেন। কারণ, তিনি দুর্নীতিতে থাকলেও নেই আলোচনায়। বহু বছর ধরে রয়েছেন একই প্রতিষ্ঠানে। মাঝে মধ্যে টেবিল বদল হলেও বদল নেই তার দুর্নীতির। কখনো প্রকল্প পরিচালক, কখনো নির্বাহী প্রকৌশলী। ফ্যাসিস্ট হাসিনার জমানায় একের পর এক টপকেছেন সাফল্যের টেবিল। ধুরন্ধর এই কর্মকর্তা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও দেখিয়ে চলেছেন কেরামতি। যোগ্য অনেককে ডিঙিয়ে বাগিয়ে নিয়েছেন রাজউকের প্রধান প্রকৌশলীর পদ। নূরুল ইসলাম এখন রাজউকের প্রধান প্রকৌশলীর (বাস্তবায়ন) চলতি দায়িত্বে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর গত ১৯ জানুয়ারি এ পদে বসেন তিনি। ‘বসেন’ বললে অবশ্য ভুল হবে। তাকে বসানো হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের দু’জন উপদেষ্টার আশীর্বাদ রয়েছে তার ওপর। তাদের বদান্যতায় দুর্নীতিবাজ নূরুল ইসলাম এখন দেশের বৃহৎ দুর্নীতিপ্রবণ প্রতিষ্ঠানের ‘হারকিউলিস’। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেকচার ছাড়ছেন। নগর উন্নয়নে কপচাচ্ছেন বড় বড় বুলি। নিজেই সমস্যা সৃষ্টি করে ‘সমস্যার নগরী ঢাকা’কে নিপতিত করছেন ততোধিক সমস্যায়। ঠা-া মাথার প্রকৌশলী নূরুল ইসলাম অতীতের দুর্নীতি ঢেকে রেখেছেন দারুণ চাতুর্যতায়। তাকে কারাগারে পাঠানো দূরে থাক, উল্টো চেপে বসেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারের উপদেষ্টাদের মাথায়।
তার দুর্নীতির অতীত খননে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে আ.লীগ সরকার আমলে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। পড়াশোনা করেন খুলনা বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট)। চাকরিতে যোগদান করেই তিনি পেয়ে যান দুর্নীতিবান্ধব হাসিনার সরকার। রাজউকের বিভিন্ন ডেস্কের দায়িত্ব পান। যেখানেই পোস্টিং পেয়েছেন সেই ডেস্কের নথির পাতায় পাতায় রেখে আসেন দুর্নীতির ‘ফুটপ্রিন্ট’। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা আবারো সরকার গঠন করেন। প্রচ-রকম আওয়ামী প্রীতি এবং বিপুল অর্থ লগ্নির মাধ্যমে ২০১০ সালে বাগিয়ে নেন পদোন্নতি। হন রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী। ২০১৬ সালে একই তরিকায় হয়ে যান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। উভয় পদে থাকাকালে বহু প্রকল্পের ‘প্রকল্প পরিচালক’ (পিডি) ছিলেন। ‘পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প’, ‘গুলশান কারপার্কিং প্রকল্প’, ‘গুলশান-বনানী লেক উন্নয়ন প্রকল্প’, ‘মাদানি এভিনিউ প্রকল্প’র মতো বৃহৎ প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। বিভিন্ন সময় নূরুল ইসলামের ব্যপক দুর্নীতির বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক চেয়ারম্যান এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দাখিল হয়। কিন্তু আওয়ামী শেল্টারের থাকায় কোনো প্রতিষ্ঠানই তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দুদক তার বিরুদ্ধে দুটি অনুসন্ধান চালায়। কিন্তু কোটি কোটি টাকা এবং পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের বিনিময়ে দুদক কর্মকর্তারা তাকে দু’বারই দায়মুক্তি দেন। এখন পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের দায়ে হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য এবং কতিপয় রাজউক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। অনুসন্ধান-তদন্ত হচ্ছে। চার্জশিটও দেয়া হয়েছে হাসিনা-রেহানা-জয়-পুতুলসহ বেশ ক’জন রাজউক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। অথচ রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের পিডি প্রকৌশলী নূরুল ইসলাম রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাকে অনুসন্ধানের আওতায়ই আনা হয়নি।
কোটি কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য : রাজউকের দুর্নীতিপ্রবণ প্রকল্পের একটি হচ্ছে ‘মাদানি এভিনিউ’ প্রকল্পে। এ প্রকল্পে শত কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী নূরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। পছন্দসই ছয় আওয়ামী ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দিয়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে তিনি কমিশন বাবদ তিনি হাতিয়ে ৫ শতাংশ অর্থ। হাসিনার শাসনামলজুড়ে গোপালগঞ্জের কর্মকর্তা এবং শেখ হেলাল-সমর্থিত একটি সিন্ডিকেটই দেড় দশক ধরে কার্যাদেশ পেয়ে আসছেন। প্রধান প্রকৌশলীর (বাস্তবায়ন) চেয়ারে বসে এখনো নূরুল ইসলাম সেই সিন্ডিকেটই মেনটেইন করছেন।
শত কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য হয় নূরুল ইসলামের ‘পূর্বাচল নতুন শহর’ প্রকল্পের উন্নয়ন কাজেও। উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে গত বছর নভেম্বরে পূর্বাচলে ৯টি গ্রুপ এবং উত্তরা প্রকল্পে আটটি গ্রুপে কাজ হয়। এর মধ্যে উত্তরা প্রকল্পের উন্নয়ন কাজের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৫ কোটি টাকা। এছাড়া উত্তরা সুইমিংপুল নির্মাণকাজে ১৭ কোটি ও মাদানি এভিনিউর রাস্তা নির্মাণে ‘কোটি টাকা বরাদ্দ’ ছিল। পূর্বাচল ও উত্তরা প্রকল্পে মোট ১৭ গ্রুপের কাজে মোট বরাদ্দ ছিল অন্তত ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু ঠিকাদার মনোনয়ন থেকে শুরু করে কার্যাদেশ প্রদান পর্যন্ত ছিল অস্বচ্ছতায় ভরপুর। ৫ শতাংশ হারে কমিশন নিয়ে প্রকৌশলী নূরুল ইসলাম গং এই খাত থেকে পকেটস্থ করেন অন্তত ২৫ কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এ কার্যাদেশ প্রদানে নূরুল ইসলাম গংয়ের সঙ্গে ‘নেগোশিয়েট’ করেন কথিত ছাত্রনেতা দুলাল মিয়া।
অতি সম্প্রতি রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে ৯ গ্রুপ কাজের ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এই টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে গুরুতর দুর্নীতি, অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী নূরুল ইসলাম ৫ শতাংশ কমিশন নিয়ে ছয় আওয়ামী ঠিকাদার ও একজন জাতীয় পার্টি অনুসারী ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেন। সরকার বদল হলেও বদল হয়নি ‘বিএনপি সমর্থক’ দাবিদার নূরুল ইসলামের আওয়ামীপ্রীতি। এখন তিনি ‘বঞ্চিত’ এবং ‘বিএনপি সমর্থক’ দাবি করলেও ফ্যাসিস্ট শাসনামলে তিনি ‘সার্ভ’ করেন আওয়ামী লীগকেই। যে কারণে বিভিন্ন প্রকল্পের দায়িত্বে থাকাকালে দু’হাতে লুটতে পেরেছেন কোটি কোটি টাকা। নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। নিজ এলাকা চাপাইনবাবগঞ্জেও কিনেছেন বেনামে সম্পত্তি। অর্থ পাচারের অভিযোগও ছিল নূরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংস্থাটিতে অন্তত দু’বার অনুসন্ধানের নথি ওঠে কমিশনে। একটি নথিতে সাবেক রাজউকের সাবেক আওয়ামীপন্থি চেয়ারম্যান নূরুল হুদাসহ একাধিক প্রকৌশলী এবং কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। আরেকটিতে অভিযোগ ছিল এককভাবে নূরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। শেষোক্তটিতে ক্ষমতার অপব্যবহার ও নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোনো অনুসন্ধানই মামলা পর্যন্ত গড়ায়নি। জানা গেছে, তৎকালীন রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা এবং প্রকৌশলী মো. নূরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদকের যেসব কর্মকর্তারা অনুসন্ধান করেছেন, তাদেরকে উত্তরা এবং পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট উপঢৌকন দিয়ে অভিযোগ থেকে তারা দায়মুক্তি নেন। তাদের দায়মুক্তি প্রদানের বিনিময়ে ‘বিশেষ বিবেচনা’য় প্লটপ্রাপ্ত দুদক কর্মকর্তাদের মধ্যে তৎকালীন পরিচালক কাজী শফিকুল আলম, নাসিম আনোয়ার, তৎকালীন দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন, সাবেক ডিজি রেজানুর রহমান, ডিজি (প্রশাসন) রিজওয়ানুর রহমান, সাবেক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহিরুল হকের নাম জানা যায়। দায়মুক্তির বিনিময়ে রাজউকের প্লট উপঢৌকন নেয়ার এই প্রচলন চালু হয় রাজউক এবং দুদক কর্মকর্তাদের মধ্যকার অদৃশ্য সমঝোতায়। ফলে রাজউকের বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে অনেক পদস্থ কর্মকর্তা জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। মামলা হয় শুধু রাজউকের নি¤œতম পদে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। দুদকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা অদৃশ্য এ সমঝোতার কথা স্বীকার করে জানান, রাজউক একটি দুর্নীতিপ্রবণ প্রতিষ্ঠান। অথচ দুর্নীতির বিস্তার, পরিধি ও টাকার অঙ্কের তুলনায় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার সংখ্যা নগণ্য।
তবে নিজেকে সৎ দাবি করে মো. নূরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে দুদক কখনো কোনো অনুসন্ধান করেনি বলে জানান। প্রশ্নের জবাবে গতকাল মঙ্গলবার তিনি বলেন, আমি তো বিএনপির লোক! দীর্ঘদিন বঞ্চনার শিকার হয়েছি। ১৫ বছর আমাকে কাজই করতে দেয়া হয়নি। হয়রানিমূলকভাবে গাজীপুর পাঠিয়ে দেয়া হয়। পদোন্নতি দেয়া হয়নি। সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরই মাত্র চলতি দায়িত্ব পেয়েছি চিফ ইঞ্জিনিয়ারের। চাকরি আছে মাত্র কয়েক মাস।