
দেশের সব শ্রমিকের জন্য একটি ন্যূনতম জাতীয় মজুরি ঘোষণা , জাতীয় স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠনসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন । গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ড . মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে এসব সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন তুলে দেন কমিশনের সদস্যরা ।‘ শ্রমজগতের রূপান্তর - রূপরেখা” শীর্ষক ৪৫০ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় ও খাতভিত্তিক মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাসহ ২৫ ধরনের সুপারিশ তুলে ধরা হয় । অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের ( বিআইএলএস ) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে ১০ সদস্যের এই শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে । কমিশন দীর্ঘ পাঁচ মাস কাজ করে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে । কমিশন যেসব সুপারিশ প্রস্তাব করেছে , সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দেশের সব শ্রমিকের জন্য একটি ন্যূনতম জাতীয় মজুরি ঘোষণা করা ।
এটি প্রাতিষ্ঠানিক - অপ্রাতিষ্ঠানিক , সরকারি- বেসরকারি , দেশি - বিদেশি ও ব্যক্তিপর্যায়ে নিয়োজিত সব শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের মানদণ্ড হিসেবে কাজ করবে । জাতীয় ন্যূনতম মজুরির পাশাপাশি খাতভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার সুপারিশও করেছে সংস্কার কমিশন । এ ক্ষেত্রে কাজের প্রকৃতি , ঝুঁকি , খাতভিত্তিক চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি খাতের জন্য আলাদা ন্যূনতম মজুরি ঠিক করতে হবে । তবে এই মজুরির হার কোনোভাবেই জাতীয় ন্যূনতম মজুরির কম হবে না ।
উল্লেখ্য , তৈরি পোশাক , ট্যানারিসহ ৪২ টি খাতে নিম্নতম মজুরির ঘোষণা রয়েছে । আরও শতাধিক খাতের শ্রমিকদের জন্য কোনো নিম্নতম মজুরি নেই এখনো । জানতে চাইলে শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান আজকের পত্রিকাকে বলেন , শ্রমিকদের জন্য এটি প্রাথমিক গাইডলাইন । এখানে স্বল্প , মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ রয়েছে । এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হ শ্রমিকদের কল্যাণ হবে । শ্রমবাজার ও ভালো হবে । তবে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি সামনে রেখে গণতান্ত্রিক সরকারকে বাস্তবায়ন করতে হবে ।
সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনে শ্রমিকের সংজ্ঞা পরিবর্তন করার সুপারিশ করা হয়েছে । এ ছাড়া ‘ মহিলা’কে মহিলা না বলে ‘ নারী ’ বলা , মালিককে ‘ মালিক ’ না বলে ‘ নিয়োগকারী ’ বলা এবং কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের তুই-তুমি সম্বোধন না করার সুপারিশ করা হয়েছে । কমিশন খাতভিত্তিক শ্রমিকদের মধ্যে গাড়িচালকদের কাজের সময় সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা নির্ধারণের কথা বলেছে । এ ছাড়া কৃষিশ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৮০০-১০০০ টাকা করা, শ্রমিকদের জন্য‘ আবাসন তহবিল ' গঠন, পরিবার ও সন্তানদের জন্য ‘ রেশন শপ” চালু করারও সুপারিশ করেছে । শ্রমিকদের জন্য‘ বেকারত্ব ভাতা চালু এবং শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণবিষয়ক অধিদপ্তর করার জন্যও সুপারিশ করা হয়েছে ।
কর্মক্ষেত্রে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা , তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডসহ উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনা-পরবর্তী সরকারি কার্যক্রম , তদন্ত ও বিচার ক্ষতিপূরণ , শ্রমসংশ্লিষ্ট দেশি - বিদেশি আর্থিক অনুদান ব্যয় নিয়ে শ্বেতপত্র প্রস্তুতের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন । পাশাপাশি শ্রমিককল্যাণ ফাউন্ডেশন ফান্ডের ব্যবহার, জাতীয় ন্যূনতম মজুরির সুপারিশ করোনা মহামারিসহ বিভিন্ন সময় সরকারি প্রণোদনা — বিশেষ সহযোগিতা এবং শিশুশ্রম নিরসনসংক্রান্ত সরকারি প্রকল্পের সফলতা ও ব্যর্থতা শীর্ষক শ্বেতপত্র প্রকাশ করার বিষয়ে প্রতিবেদনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ।
সংস্কার কমিশনের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টার উপ- প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার সংবাদমাধ্যমকে জানান , শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নের বিষয়ে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার আগ্রহ রয়েছে ।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন , আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিটি সুপারিশকে দেখা হবে । তারা দেখবে , শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সরকার কীভাবে কাজ করছে । আজাদ মজুমদার বলেন , প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের পরামর্শ দিয়েছেন , এই প্রতিবেদন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে যেন কথা বলেন , যাতে করে ঐকমত্য কমিশন যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে , সেখানে যেন এই প্রসঙ্গগুলো রাখতে পারেন । শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা থাকাটাও জরুরি ।
তথ্যভান্ডার গঠনের সুপারিশ করেছে , যাতে শ্রমিকদের পরিচয়পত্র রাখা হয় । বিভিন্ন আন্দোলনে অনেক শ্রমিকের নামে মামলা হয়েছে । এ মামলাগুলো প্রত্যাহারের জন্য দ্রুত সরকারকে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে । শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার যেন আরও সহজ করা যায় , সেটির কথা বলা হয়েছে । শ্রমিকের দর - কষাকষি যেন নিশ্চিত করা যায় , সেই বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে । কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে একটি নির্দেশনা আছে , সেই নির্দেশনার আলোকে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও যৌন নিপীড়নের বিষয় যেন নিশ্চিত করা হয় , সে বিষয়ে সরকারকে কাজ করার জন্য সুপারিশ করেছে কমিশন । ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির সুপারিশের পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য একটা সর্বজনীন তহবিল তৈরির কথা বলেছে কমিশন , যাতে করে এই তহবিলের মাধ্যমে শ্রমিকেরা সুবিধা পান , তাঁরা কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে যেন এই তহবিল থেকে তাঁদের সহায়তা করা হয় ।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে । প্রাতিষ্ঠানিক , অপ্রাতিষ্ঠানিক , কৃষি , গৃহভিত্তিক , অভিবাসী , স্বনিয়োজিতসহ শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রের আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয় এতে । এই লক্ষ্যে কাজের স্বীকৃতি ও পরিচয়পত্র নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা , মর্যাদাকর - শোভন কর্মপরিবেশ , চাকরির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ , অস্থায়ী ও এজেন্সিনির্ভর নিয়োগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয় প্রতিবেদনে ।
সুপারিশের বিষয় তুলে ধরে আজাদ মজুমদার বলেন , তাঁরা মূল যে সুপারিশের কথা বলেছেন , সেটি হচ্ছে সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা । তাঁরা পর্যালোচনা করে দেখেছেন , আমাদের দেশে ৮ কোটি শ্রমজীবী মানুষ আছেন । তাঁদের মধ্যে ৮৫ ভাগ ( ৭ কোটি ) শ্রমিকেরই কোনো আইনি সুরক্ষা নেই । তাঁরা সুপারিশ করেছেন , শ্রমিকদের জন্য যেন একটি আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয় । পাশাপাশি সংস্কার কমিশন নিরাপদ জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটা সুপারিশ তাঁরা করেছেন ; যাতে বিভিন্ন সুপারিশ করেছে । এ জন্য করে সব ধরনের শ্রমিক যেন শ্রমিকদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত জাতীয়ভাবে ন্যূনতম মজুরির আওতায় কর্মপরিবেশ , স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার আসতে পারেন । তাঁরা এটা নিশ্চিত আইনি অধিকার নিশ্চিত করা , খাত ও করতে বলেছেন । পেশাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্য ও সংস্কার কমিশন শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করবে দুর্ঘটনায় বা অবহেলার কারণে নিহত- আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ মানদণ্ড পুনর্মূল্যায়ন করার কথা বলা হয় প্রতিবেদনে ।
জবাবদিহিমূলক প্রশাসনব্যবস্থা নিশ্চিতের লক্ষ্যে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে স্থায়ী শ্ৰম কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন । স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে অবিলম্বে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি ‘ জাতীয় সামাজিক সংলাপ ফোরাম ' গঠনে উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে । কর্মক্ষেত্রে সম - অধিকার নিশ্চিত এবং সহিংসতা ও বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে কিছু সুপারিশ করেছে কমিশন । তাদের প্রতিবেদনে বলা হয় , রাষ্ট্র নারী- পুরুষ , অন্যান্য লিঙ্গ , জাতি , ধর্ম , বর্ণ , গোষ্ঠীভেদে মজুরি , ট্রেড ইউনিয়ন , সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াসহ শ্রম খাতের সর্বত্র বৈষম্য নয় ; সম - অধিকার নিশ্চিতে কার্যক্রম গ্রহণ করবে । পাহাড়ে সমতলে আদিবাসী ও বহুজাতির জনগোষ্ঠীর শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয় , যৌন হয়রানিসহ সব ধরনের হয়রানি ও সহিংসতা থেকে শ্রমিকের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতে রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে । ২০০৯ সালের হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সব কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতাবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে । একই সঙ্গে অভিযোগ সেল ও নিষ্পত্তি কমিটি গঠন করা জরুরি । আইএলও ১৯০ কনভেনশন অনুসমর্থন করে । সর্বজনীন মাতৃত্বকালীন সুরক্ষার জন্য কমিশনের করা সুপারিশে বলা হয়েছে , সব নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি সবেতনে ৬ মাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে রাষ্ট্র । এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারের সহায়তা প্রদান এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ স্কিম প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে এতে ।