
স্থানীয় সরকারের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি (মেয়র, চেয়ারম্যান) পদে সরাসরি নির্বাচন না করার প্রস্তাব দিয়েছে এ সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন। এই প্রস্তাব গৃহীত বা বাস্তবায়ন হলে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের অধিকার খর্ব হবে। তাতে মেম্বার-কাউন্সিলরদের হাতে চলে যাবে ভোটাধিকার।
নির্বাচন-বিশেষজ্ঞদের মতে, সংস্কার কমিশনের এধরনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে কেনা-বেচার হাঁট বসবে। নির্বাচনে এটি আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের একটা মডেলে পরিণত হবে। জনগণ জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। নির্বাচনি ব্যবস্থায় ‘কেনা-বেচার হাট’ বসবে। এ প্রক্রিয়াকে ৬৫ বছর আগের আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ব্যবস্থার সাথে তুলনা করছেন অনেকে।
এদিকে, এ নিয়ে দুই সংস্কার কমিশনের বিপরীতমুখী মতামতে জটিলতাও দেখা দিয়েছে। ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন সংস্কার কমিশন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুপারিশ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা মেয়র, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে জনগণের কোনো ভোটাধিকারের কথা রাখা হয়নি। কমিশন এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নির্বাচিত করার দায়িত্ব মেম্বার এবং কাউন্সিলরদের উপর ন্যস্ত করার প্রস্তাব করেছে।
এর আগে ড. তোফায়েল আহমেদ যখন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য ছিলেন, দেশের সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান, মেয়রসহ শীর্ষ পদে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচন অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কমিশনের সাত সদস্যের মধ্যে ছয়জন সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিলেও, একমাত্র সদস্য তোফায়েল আহমেদ পরোক্ষ নির্বাচনের প্রস্তাব দেন। ওই কমিশনে পরোক্ষ নির্বাচনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হওয়ার দুই মাস পরে ড. তোফায়েল আহমেদ স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান মনোনীত হন। এরপর গত রবিবার তিনি প্রধান উপদেষ্টার কাছে ৫১টি প্রধান সুপারিশ সম্বলিত চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
তাদের সুপারিশ অনুযায়ী, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচন জনগণের সরাসরি ভোটে না করে প্রথমে সদস্য বা কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত করা হবে। পরে নির্বাচিত কাউন্সিলর ও সদস্যদের ভোটে চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচন করা হবে। সদস্য বা কাউন্সিলর পদে পূর্ণকালীন সদস্যের পাশাপাশি খন্ডকালীন সদস্য রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় সরকারি চাকরিজীবীরাও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে সদস্য বা কাউন্সিলর হওয়ার সুযোগ পাবেন। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠাগুলোর কাঠামোর বিষয়ে বলতে গিয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে তাঁরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থার বিষয়টি চিন্তা করেছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচন করা হয়, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা হয় না। এখানেও সব স্তরে (ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন) শুধু সদস্য ও কাউন্সিলর নির্বাচন হবে। একই তফসিলে এই নির্বাচন করা যাবে। এরপর সভাপতি নির্বাচন করা হবে। এটি হলো বিধানিক অংশ। এরপর সভাপতির সভাপতিত্বে চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচন করা হবে। তারপর চেয়ারম্যান বা মেয়র তিনজন বা পাঁচজনের একটি পূর্ণকালীন কাউন্সিল করবেন। তাঁরা পূর্ণকালীন কাজ করবেন এবং পূর্ণকালীন বেতন-ভাতা পাবেন। আর বাকি যাঁরা আসবেন, তাঁরা খন্ডকালীন। তাঁরা স্থায়ী কমিটির সভাপতি-সদস্য হবেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব সুপারিশ কার্যকর হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছে জনগন তুচ্ছ হয়ে যাবে। যেহেতু জনগনের ভোটে তারা নির্বাচিত হবেন না, তাই তাদের কাছে মেম্বার এবং কাউন্সিলররা অধিক গুরুত্ব পাবে। এমনকি মেম্বার এবং কাউন্সিলর নির্বাচনের আগে যারা মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে চান তারা প্রার্থীদের সঙ্গে আঁঁতাত করবে। এর আগে সর্বশেষ কয়েকটি জেলা পরিষদ নির্বাচনে এমন চিত্র দেখা গেছে। জেলা পরিষদে পরোক্ষ ভোটের যে ব্যবস্থা বর্তমানে রয়েছে, তা সুখকর হয়নি। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ধনী ব্যক্তিরাই সাধারণত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এমনকি একজন চেয়ারম্যানকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে পদ কেনার অভিযোগও রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, একই রকম পরিস্থিতি মেয়র ও চেয়ারম্যান নির্বাচনে ঘটলে তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠবে।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার এই প্রস্তাব অনেককেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জেনারেল আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের কথা। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে চালু হওয়া মৌলিক গণতন্ত্র ছিল চার স্তরবিশিষ্ট একটি সীমিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যেখানে জনগণের নির্বাচিত বিডি মেম্বাররাই প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচন করতেন। সরাসরি ভোটের কোনো সুযোগ ছিল না সাধারণ মানুষের। বিশ্লেষকদের মতে, সেই পরোক্ষ পদ্ধতির ফলাফল ছিল স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, স্থানয়ি সরকারের মেয়র এবং চেয়ারম্যান পদে সরাসরি ভোট হলে তারা রাজা হয়ে যান, এজন্য কাঠামো ভাঙার সুপারিশ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের সব বডির জন্য একই সিস্টেম চালু করা হয়েছে। কাউন্সিলর ও মেম্বার পদে সরাসরি ভোট হবে, পরে কাউন্সিলরদের ভেতর থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়র হবেন। আর মেম্বারদের মধ্য থেকে ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। স্থানীয় সরকারকে দুই স্তর বিশিষ্ট করা হয়েছে-বিধানিক অংশ এবং নির্বাহী অংশ। বিধানিক অংশের প্রধান হবেন সভাধ্যক্ষ এবং নির্বাহী অংশের প্রধান হবেন মেয়র অথবা চেয়ারম্যান। সভাধ্যক্ষও নির্বাচন করবেন কাউন্সিলর রা । এই সিস্টেম চালু করা গেলে স্থানীয় সরকার প্রশাসনে জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল আলীম ইত্তেফাককে বলেন, কিছু দেশে এমন প্র্যাকটিস আছে, কিন্তু এই পদ্ধতিটি বাংলাদেশের জন্য বাস্তবসম্মত নয় এবং এটা বাস্তবায়ন করা অনেক চ্যালেঞ্জিং। এতে করে জনগনের হাতে আর নির্বাচন থাকবে না। নির্বাচনে টাকার খেলা হবে। প্রতারিত হবে জনগন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বর্তমান জেলা পরিষদের ভোট হয় স্থানীয় সরকারের অন্যান্য বডির সদস্যদের নিয়ে। ইনর্বাচনগুলোতে টাকায় বিক্রি হন জনপ্রতিনিধিরা। জনগন প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার সুযোগ পান না। পরোক্ষ ভোটে চেয়ারম্যান মেয়ররা নির্বাচিত হলে জনগনের প্রতি দ্বায়বদ্ধতা থাকে না।