
গুমের মাত্র পাঁচ দিন আগে বিএনপি নেতা, তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে অপহরণের চেষ্টা করেছিল রাষ্ট্রের একটি বাহিনীর সদস্যরা। তবে ভাগ্যক্রমে সেই যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। স্থানীয় জনতা ও পুলিশের সহায়তায় রক্ষা পান। সে ঘটনার অদ্যোপান্ত পুলিশের খাতায় রেকর্ড হলেও তা ওপরের নির্দেশেই গোপন রাখা হয়। এরপর তাকে তুলে নেওয়া হলেও আর খোঁজ মেলেনি। পেরিয়ে গেছে ১৫টি বছর। বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে অপহরণের ঘটনাটি সত্য বললেও কে বা কারা অপহরণ করেছে, তা বলা হয়নি। এদিকে এই ১৫ বছর চৌধুরী আলমের পরিবার দুঃসহ সময় কাটিয়েছে। নানা হুমকি ও ভয়ভীতির মধ্যে থাকতে হয়েছে সবাইকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারা এবং কেন চৌধুরী আলমকে অপহরণ করেছিল তা পরিষ্কার। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী আলম ছিলেন বহু পক্ষের টার্গেট। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পাশাপাশি ছিল অর্থনৈতিক বিষয়। তবে সব স্রোত মিলিত হয় এক মোহনায়। জানা যায়, গুম হওয়ার আগে গুলশানে সাদা পোশাকে র্যাব চৌধুরী আলমকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেই ব্যর্থ চেষ্টার ঘটনাটি লিপিবদ্ধ হয় পুলিশের খাতায়। গুলশান থানার সেই ফোর্স হাজির নোট-এর বাদী ছিলেন উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আলী। বর্তমানে তিনি পরিদর্শক পদে পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত। ফোর্স নোটে তিনি বলেন, গুলশান ৭২ নম্বর রোডে লাল রঙের হাফহাতা শার্ট পরিহিত মোটরসাইকেলে থাকা একজন এবং সঙ্গে থাকা আরও ১৫-১৬ ব্যক্তি চৌধুরী আলমকে অপহরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু মোটরসাইকেলে থাকা ব্যক্তিকে স্থানীয় লোকজন আটকে ফেলে। পরে গুলশান থানা পুলিশ দীর্ঘ ৩০ মিনিট তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তিনি নিজেকে এএসআই বিল্লাল এবং র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত বলে স্বীকার করেন। ওই সময় বিল্লাল তার পরিচালকের সঙ্গেও এসআই মোহাম্মদ আলীকে কথা বলিয়ে দেন। জানা গেছে, ২০১০ সালের ২৫ জুন ফার্মগেট ইন্দিরা রোড থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় আলমকে। কেবল গাড়িচালক অসীম চন্দ্র ভৌমিককে রেখে তাকে বহনকারী গাড়িটিও নিয়ে নেয়। পরদিন ওই গাড়ির সন্ধান মেলে কারওয়ান বাজার ওয়াসা ভবনের বিপরীতে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গঠিত ‘গুম তদন্ত কমিশনে’ চৌধুরী আলমের সন্ধান চেয়ে আবেদন করেন তার ছেলে আবু সাঈদ চৌধুরী। তার আর্জি ছিল তাকে মেরে ফেলা হলেও কোথায় কীভাবে তার শেষ প্রয়াণ হয়েছে তা জানার।
এ বিষয়ে গুম তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু চৌধুরী আলম নন, প্রতিটি ঘটনাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
দুটি খুদে বার্তা : চৌধুরী আলম গুম হওয়ার এক মাস আগে তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার মোবাইলে দুটি খুদে বার্তা এসেছিল র্যাবের তৎকালীন গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তার মোবাইল থেকে। বার্তা ছিল, দলীয় কর্মকা থেকে নিষ্ক্রিয় না হলে চৌধুরী আলমের পরিণতি প্রয়াত কমিশনার নিউটন এবং কমিশনার আহমদের মতো হবে। চৌধুরী আলম রেড লিস্টে আছেন। প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা নিজে তার সিটিসেল মোবাইলে আসা ওই দুটি খুদে বার্তা চৌধুরী আলমের বড় ছেলে আবু সাঈদকে দেখিয়েছিলেন বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে তিনি দাবি করেছেন।
রহস্যজনক আচরণ : ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল আদালতে একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন তৎকালীন মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. কামরুজ্জামান ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঢাকা মেট্রো (উত্তর) পুলিশ পরিদর্শক মো. শাহানুর বারী। তাতে উল্লেখ ছিল, বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণে চৌধুরী আলম অপহরণের বিষয়টি সত্য প্রমাণিত হলেও তাকে কে বা কারা অপহরণ করেছে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
তবে গত ১০ মার্চ চৌধুরী আলমের ছেলে আবু সাঈদ চৌধুরী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও গ্রেপ্তার সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) এম সোহায়েল, লে. জেনারেল (অব.) মো. মুজিবরসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।
যা বলছে আলমের পরিবার : বড় ছেলে আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, বঙ্গবাজার, পীর ইয়ামেনী মার্কেট এবং ফুলবাড়িয়া সিটি মার্কেট নিয়ে বাবা টার্গেটে ছিলেন। টার্গেট করেন আওয়ামী লীগের মায়া চৌধুরী, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সাবেক এমপি আফজাল, আবদুর রহমান হুজুর, আবদুল বাসেত মাস্টার গং। নিজেরা ব্যর্থ হয়ে সরকারি বাহিনীর সহায়তায় আমার বাবাকে গুম করে তারা। তিনি আরও বলেন, ২৫ জুন রাতে চৌধুরী আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এমন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল একাধিক টেলিভিশন ও পত্রিকায়। ওই রাতে ডিবিতে কর্মরত ইন্সপেক্টর নাসির নামের একজন বাবাকে মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে রাখার বিষয়টি জানিয়েছিলেন। চৌধুরী আলমের প্রথম স্ত্রী হাসিনা চৌধুরী বলেন, আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর সরকার আমাদের সব সম্পত্তি নিয়ে যায়। সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে। তখন আমাদের কাছে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। শুধু থাকার মতো একটা বাড়ি ছিল। আমি চার ছেলেমেয়েকে (দুই ছেলে ও দুই মেয়ে) নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি।