Image description

দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে না বিএনপি। সরকার কি করে আরও কিছুদিন দেখতে চায়। লন্ডন থেকে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশ পেয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে। চাপে রাখার কৌশল হিসেবে রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ নিয়ে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া হচ্ছে। 
সূত্র মতে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকের আগে দলের অভ্যন্তরে সিদ্ধান্ত ছিল ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের টাইম লাইন না দিলে সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া হবে। হাইকমান্ডের নির্দেশে পরে এ অবস্থান থেকে সরে আসার কৌশল নেওয়া হয়। এছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে না যেতে বিএনপির ওপর দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের চাপও রয়েছে। 
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ে বিএনপি। এরপর দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে দীর্ঘদিন আন্দোলনের পর অনুকূল পরিবেশ পেয়ে এখন পুরোদমে নির্বাচনের পথে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে।

এ পরিস্থিতিতে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। এ সময় দলের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করা হয়। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না দিয়ে জানান, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। এতে বিএনপি ক্ষুব্ধ হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক সিদ্ধান্তে যাচ্ছে না। 
জানা যায়, আপাতত কঠোর কর্মসূচিতে না গেলেও দ্রুত নির্বাচনের দাবি থেকে বিএনপি পিছু হটবে না। এ জন্য সরকারকে চাপে রাখতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে রাজপথে নিয়মতান্ত্রিক কিছু কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- মানববন্ধন, সেমিনার, আলোচনা সভা, সমাবেশ, পদযাত্রা, গণমিছিল, গণঅবস্থান, মার্চ ফর ডেমোক্রেসি।

সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকেও যুগপৎ এসব কর্মসূচি পালন করতে বলা হবে। এছাড়া দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের সহযোগিতা চাওয়া হবে। এরপর কিছুদিন সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কর্মসূচি পালন শুরু করা হবে বলে দলীয় সূত্র জানায়। 
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে এ বছর জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানায়। পরে এ বছর অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি করে দলটি। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা জানালে, বিএনপিও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে। তবে পরে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে বলেন, এ বছর ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। বিএনপি সরকারকে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানায়। 
সর্বশেষ ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি নেতারা বৈঠক করে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা আগের মতোই জানান, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এতে বিএনপি জানায়, তারা অসন্তুষ্ট। কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলন কর্মসূচি তারা ঘোষণা করেনি। সর্বশেষ ১৭ এপ্রিল দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এখনই আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি না দেওয়ার। তবে ওই বৈঠকে কিছু নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা হয়। আর এসব কর্মসূচি সরকারকে আরও কিছুদিন সময় দিয়ে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। 
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, আমরা ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাই। আমরা বারবার বলেছি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিতে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান অস্পষ্ট। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। তাই দ্রুত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা না করলে আমরা রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করতে বাধ্য হব। 
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। আর রাষ্ট্র সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে, সংবিধানকে উপেক্ষা করে কোনো সংস্কার আমরা চাই না। নির্বাচনের পর জনপ্রতিনিধিরাই ঠিক করবেন কি কি সংস্কার প্রয়োজন। তাই আশা করছি, সরকার শীঘ্রই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। 
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, বিএনপি আগেই রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। তাই সংস্কারের জন্য নির্বাচনে কালক্ষেপণ বিএনপি মেনে নেবে না। সরকার অবিলম্বে নির্বাচনের টাইম লাইন ঘোষণা না করলে বিএনপি নেতাকর্মীরা রাজপথে নেমে নির্বাচনের দাবি আদায় করে নেবে। 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট টাইম লাইনের আশ্বাস চায় বিএনপি। কোনো কারণে ডিসেম্বরে নির্বাচন করা না গেলেও যেন তার থেকে এক-দেড়মাসের বেশি বিলম্ব না হয়। কারণ, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরু, তারপর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং এরপর বর্ষাকাল। তাই আবহাওয়াগত কারণে এ সময় দেশে নির্বাচনের পরিবেশ থাকবে না। এ ছাড়া নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, দেশে তত সংকট বাড়বে। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ভোটের পরিবেশ বিঘিœত হতে পারে।  
এদিকে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি পালনসহ প্রয়োজনীয় কৌশল নির্ধারণে আবারও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আগের মতো  বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। ইতোমধ্যেই ১২ দলীয় জোট, ও এলডিপির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। এরপর গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবে। সবার সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি হাইকমান্ডের নির্দেশ পেলে কর্মসূচি পালন শুরু করবে। 
এদিকে সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠককালে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো সংস্কার করলে তাতে বিএনপি সায় দেবে না। এছাড়া রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করতে চাইলেও বিএনপি এর বিরোধিতা করবে। 
১৭ এপ্রিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে ৭০ অনুচ্ছেদসহ অনেক প্রস্তাবে আপত্তি জানানো হয়। সংবিধানের সংশোধনীর জন্য গণভোট প্রযোজ্য নয় বলেও দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। আরও জানানো হয়, নির্বাচিত সংসদই সংবিধান সংশোধন করবে, এর বাইরে তা করা ঠিক হবে না। 
বিএনপি মনে করছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধান সংশোধনসহ যেভাবে বিপুল সংখ্যক সংস্কার কাজ করতে চাচ্ছে, তাতে এ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। তাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিকভাবে বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করে আসছে। এ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা সরকারকে চাপে রাখতে চায়। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না পেলে আন্দোলন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রাখা হয়। এ বিষয়ে সমমনা দলগুলোর মতামতও নিয়ে রাখা হয়। কিন্তু বৈঠকের পর বিএনপি হাইকমান্ড দলের মহাসচিবের কাছে বার্তা পাঠান এখনই কঠোর কর্মসূচি না দিয়ে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে। আর এ কারণেই আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ থেকে তারা বিরত রয়েছে। আরও কিছুদিন অপেক্ষার পর হাইকমান্ডের সিগন্যাল পেলেই কর্মসূচি গ্রহণ করবে।
এদিকে আগামী জাতীয় নির্বাচন বিএনপির জন্য কঠিন হবে জানিয়ে এখন থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে সারাদেশের নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাই তারেক রহমানের বিশেষ বার্তার পর এখন দলীয় নেতাকর্মীদের পদচারণায় সারাদেশেই নির্বাচনি আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের দলীয় কর্মসূচিগুলোতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিভিন্নভাবে শোডাউন করছেন। আর গণসংযোগ বাড়িয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলছেন।  
এখনও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হলেও প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে বিজয়ী হতে নানামুখী কৌশল নিয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মী এখন সারাদেশে বিভিন্ন কৌশলে গণসংযোগ পালন করছে। আর আগে থেকেই প্রতিটি সংসদীয় আসনের জন্য ৩ জন করে প্রার্থী ঠিক করে রাখলেও এখন ৩০০ আসনের জন্য প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে প্রয়োজনীয় কর্মকৌশল শুরু করেছে দলীয় হাইকমান্ড। তবে, প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হবে জাতীয়  সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর। তাই এখন থেকেই দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হাইকমান্ডের মনোযোগ আকর্ষণ করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন।