
বালুমহাল হিসেবে ইজারা নেওয়া হয়নি ; তবে দিব্যি নদীতীরের মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে । রোজ শতাধিক ট্রাক মাটি উঠছে পাড় থেকে । রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় ঘটছে এমন ঘটনা । বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতারা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত । এই মাটি ও বালু উত্তোলনে বাধা দেওয়ায় ইউএনওর বাসায় ককটেল ফোটানো হয়েছে । অভিযান চালাতে গিয়ে সাবেক ছাত্রদল নেতার দেশীয় অস্ত্রের মহড়ার মুখেও পড়েছে প্রশাসন । তবে নীরব ভূমিকায় স্থানীয় থানা - পুলিশ । চারঘাটের যেখান থেকে বালু ও মাটি তোলা হচ্ছে , সেই স্থানের ৩০০ মিটারের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি , ২০০ মিটারের মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের দুটি সীমান্ত ফাঁড়ি ( বিওপি ) , ৫০০ মিটারের মধ্যে চারঘাট থানা , উপজেলা ক্যাম্পাস , উপজেলা ভূমি অফিস এবং কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান । প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন , তাঁরা অসহায় ।
সরেজমিনে যা দেখা গেল
গতকাল সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায় , জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর পাশ দিয়ে বড়াল নদের তীর ধরে একটি রাস্তা সোজা চলে গেছে পদ্মার তীরে । রাস্তাটি দিয়ে একের পর এক ডাম্প ট্রাক নদী থেকে উঠে আসছে মাটি নিয়ে । খননযন্ত্র দিয়ে কাটা হচ্ছে মাটি । সেখানে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি । এ ছাড়া দুপাশে ২০০ মিটারের মধ্যে বিজিবির চারঘাট বিওপি এবং চারঘাট বিকল্প বিওপি । একটু দূরে উপজেলা ক্যাম্পাস ও থানা । যাঁরা ঘাট চালাচ্ছেন , তাঁদের বসার জন্য টিনের একটি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে ।
গতকাল সকালে এই প্রতিবেদক ঘাটের কাছে গেলেই তিনজন ঘরটি থেকে বেরিয়ে এসে ঘিরে ধরেন । তাঁদের একজন চারঘাট পৌর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান সান্টু । সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় ছাত্রদল নেতা মো . ওয়াসিম এবং তাঁদের সহকারী জরিব হোসেন । সান্টু জানান , তীর থেকে তাঁরা শুধু ভরাট মাটি কেটে বিক্রি করছেন । প্রতি ট্রাক মাটি বিক্রি করছেন চার হাজার টাকায় । এ সময় ট্রাক চলাচলের রাস্তা ঠিক করার কাজে নিযুক্ত শ্রমিক মো . এতিমের সঙ্গে কথা হয় । তিনি বলেন , দিনরাতে শতাধিক ট্রাকে মাটি ওঠে । বেশি মাটি ওঠে রাতে । অর্থাৎ , প্রতিদিন অন্তত ৪ লাখ টাকার মাটি অবৈধভাবে তুলে নেওয়া হচ্ছে । নেপথ্যে বিএনপি - ছাত্রদল পৌর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান সান্টু জানালেন , তিনি জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলের রাজনীতি করেন । সান্টু বললেন , ‘ ঘাটের মালিক মতলেব ভাই ।”
মতলেবুর রহমান মতলেব উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক । স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে , ঘাটের সঙ্গে আছেন উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুরাদ পাশা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক জহুরুল হক জীবনও । তবে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুরাদ পাশা আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ আমি এ রকম লোক না । সম্প্রতি আমি ৯ টা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি । গতকালই মাদার তেরেসা অ্যাওয়ার্ড আনলাম । ২৪ তারিখে কবি নজরুল অ্যাওয়ার্ড দেবে । আমি কোনো হাটঘাটের সঙ্গে নাই । জহুরুল হক জীবনও নাই । ' এদিকে সাবেক ছাত্রদল নেতা মতলেবের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় অস্ত্র , চুরি , ডাকাতি , ছিনতাই ও মাদকের ১২ টি মামলা রয়েছে । স্থানীয়রা বলছেন , আরেক পক্ষ ঘাটটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় । তাদের প্রতিহত করতে ঘাটে সারাক্ষণ রাখা হয় অস্ত্রের মজুত । ভয়ে এলাকার লোকজন নদীতীরের দিকে যান না । কেউ সেদিকে গেলে পড়তে হয় জেরার মুখে । তবে সাবেক ছাত্রদল নেতা মতলেবুর রহমান মতলেব বলেন , ‘ বিএনপির এত দিনের বঞ্চিত সকল নেতা - কর্মী এই ঘাটের সঙ্গে আছে । ' ইজারা ছাড়াই মাটি কাটার বিষয়ে তিনি বলেন , “ আমরা তো বালু কাটছি না । ভরাট মাটি কাটছি । ইজারা দিলে বালু কাটব । ’ সাবেক এই ছাত্রদল নেতা জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন । যোগাযোগ করা হলে আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল বলেন , ‘ আমি মাটি কাটার বিষয়ে কিছুই জানি না । আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম । ’
বাধা দিয়ে বিপাকে প্ৰশাসন তিন বছর আগেও এই বালুমহাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ইজারা দেওয়া হতো । কিন্তু পুলিশ একাডেমি , উপজেলা ক্যাম্পাসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হুমকির মুখে পড়ায় বালুমহালটির ইজারা বন্ধ করে দেওয়া হয় । সর্বশেষ গত বছরের ৪ ডিসেম্বর উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভূমি ) আরিফ হোসেন চারঘাট উপজেলার বালুমহালের বাস্তব অবস্থার তদন্ত প্রতিবেদন দেন । তিনি সেখানকার বালুমহাল ইজারা না দেওয়ার সুপারিশ করেছেন । স্থানীয়রা জানিয়েছেন , আওয়ামী সরকারের পতনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিএনপি ও সাবেক ছাত্রদল নেতারা অবৈধভাবে ঘাটটি চালু করেন । পুলিশ একাডেমি হুমকির মুখে পড়লেও থানা - পুলিশের অসহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে ।
সূত্র বলছে , বালুমহাল থেকে প্রতি সপ্তাহেই থানায় টাকা যাচ্ছে । সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে , অবৈধ ঘাট চালু করার খবর পেলে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও ) সানজিদা সুলতানা ও সহকারী কমিশনার ( ভূমি ) আরিফ হোসেন সরেজমিনে পরিদর্শনে যান । কিন্তু লোকজনের সশস্ত্র অবস্থান দেখে তাঁরা ফিরে আসেন । এরপর ২১ ডিসেম্বর রাত ৮ টার দিকে ইউএনও সেনাবাহিনীর একটি টহল দলকে সেখানে পাঠান । সেদিন সেনাবাহিনী মাটি কাটা বন্ধ করে আসে । পরদিন ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭ টার দিকে মতলেব থানায় গিয়ে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি ) আফজাল হোসেনের সঙ্গে বসে চা পান করেন । বের হন রাত ৮ টার দিকে । রাত সাড়ে ৮ টার দিকে ইউএনওর বাসভবন লক্ষ্য করে কয়েকটি ককটেল ছোড়া হয় । সেই রাতে ইউএনও ওসিকে ফোন সেই রাতে ইউএনও ওসিকে ফোন করলে ওসি বলেন , পটকা ফুটেছে । পরদিন ২৩ ডিসেম্বর মতলেব ও তাঁর লোকজন ইউএনওর বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ মিছিল করেন । সেই রাত থেকে আবারও মাটি কাটা শুরু হয় , যা এখনো চলমান । এর মধ্যেই ৩১ ডিসেম্বর ইউএনও বদলি নিয়ে চলে যান ।
নতুন ইউএনও আসেন জান্নাতুল ফেরদৌস । তিনি আসার পরে গত ২০ ফেব্রুয়ারি উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভূমি ) আরিফ হোসেনকে নিয়ে মাটি কাটার জায়গাটি পরিদর্শন করেন এবং খাসজমির সঠিক সীমানা নির্ধারণ করে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেন । এখানে মাটি কাটা যাবে না বলে সাইনবোর্ডও স্থাপন করেন । সেই লাল পতাকা ও সাইনবোর্ড খুলে ফেলে আবারও মাটি কাটা হচ্ছে ।
সর্বশেষ ১১ এপ্রিল বিকেলে সেখানে অভিযানে যান ইউএনও জান্নাতুল ফেরদৌস , এসি ল্যান্ড আরিফ হোসেন ও থানার নতুন ওসি মিজানুর রহমান । অভিযানে সহযোগিতায় ছিলেন মাত্র চারজন আনসার সদস্য । উপজেলা প্রশাসনের কর্মচারীরা খননযন্ত্র অকেজো করার চেষ্টা করলে সেখানে আসেন মতলেবুর রহমানের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন দেশীয় অস্ত্রধারী । এই অবস্থায় যথেষ্ট ফোর্স না থাকায় অভিযান না চালিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয় উপজেলা প্রশাসন । ওসি সেখানে উপস্থিত থাকলেও একজন পুলিশ সদস্যও সেখানে আসেননি । তবে চারঘাট থানার ওসি মিজানুর রহমানের দাবি , তিনি প্রশাসনকে সহযোগিতা করছেন । থানার পাশে মাটি কাটা চলছে কি না , এমন প্রশ্নে তিনি বলেন , “ এটা আমার জানা নেই । ' এসি ল্যান্ড আরিফ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ আমরা মাটি কাটা বন্ধ করতে কয়েক দফা চেষ্টা করেছি । এখন মনে হচ্ছে , সেখানে গেলে আমাদেরই নিরাপত্তার সংকট দেখা দেবে । সেখানে সার্বক্ষণিক লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে থাকে । এটা বন্ধ করতে হলে পুলিশ , সেনাবাহিনী , বিজিবি , পরিবেশ অধিদপ্তর ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে সমন্বিত অভিযান দরকার । ' ইউএনও বলেন , “ আমরা অবৈধ মাটি খনন দেখেছি । এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনা হুমকির মুখে । বেশ কয়েকবার অভিযানও চালিয়েছি , কিন্তু বন্ধ হয়নি । আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট দিয়েছি । দেখা যাক , কী হয় । ’