
নানা অপরাধে জড়িয়েও বহাল তবিয়তে রয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তদন্তের নামে সময় দীর্ঘ করে অপরাধে জড়িত কর্মকর্তাদের রক্ষায় মরিয়া প্রভাবশালী চক্র। শুধু তাই নয়, জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যাওয়া বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ২০০ পুলিশ কর্মকর্তা এখনো কাজে ফেরেননি।
অন্তর্বর্তী সরকার ও বাহিনীর তরফ থেকে তাদের একাধিকবার যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হলেও এ কর্মকর্তাদের সাড়া মিলছে না। তারা কোথায় আছেন, সে বিষয়ে নানা গুঞ্জন-ধোঁয়াশা ছড়ালেও স্পষ্ট তথ্য নেই কারও কাছে। পলাতক এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কোন উদ্যোগ নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ সদর দপ্তরের। অন্যদিকে গত ১২ এপ্রিল ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধানের পদ থেকে রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ দশ দিনেও পুলিশ বাহিনীর অতিগুরুত্বপূর্ণ এই ইউনিটটি চলছে প্রধান ছাড়াই।
সম্প্রতি এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, যারা এখন আর পুলিশ বাহিনীতে নেই, তারা এখন সন্ত্রাসী। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পলাতক ও চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের অফিসিয়াল পাসপোর্ট বাতিলের প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে; যাতে তারা দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন। পাসপোর্ট অধিদপ্তর ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্র চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, জেলা জুড়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নরসিংদীর পুলিশ সুপার (এসপি) আব্দুল হান্নানের বিরুদ্ধে। অভিযোগের ফিরিস্তিতে কী নেই! পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়, আদালতের মালখানায় না পাঠিয়ে মাদকদ্রব্য গায়েব করে দেওয়া, নিজে এসপি হতে গিয়ে একজনকে দেওয়া ঘুষের ৫০ লাখ টাকা তুলতে পুলিশকে ব্যবহার, মাদক কারবারি এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়সহ নানান অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এরপরেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না পুলিশ সদর দপ্তর। এমনকি এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে।
শুধু হান্নান নয়, দশটি জেলার এসপি নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছেন ব্যাপকভাবে। এসব পুলিশ সুপারদের দুর্নীতি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। তার পরেও তাদের বিষয়ে নীরব দর্শক যেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আর পুলিশ সদর দপ্তর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ম্যানেজ করেই নিজ পদে বহাল রয়েছেন এসব দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তারা।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর ইনকিলাবকে বলেন, যে সকল পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মামলায় সম্পৃক্তদের অবস্থান সনাক্তের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুলাইতে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে এই আন্দোলন ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীদের দমনে মাঠে নামালে সহিংসতার শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটূক্তি করলে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্নিগর্ভ হলে আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হাসিনার সরকার। একইভাবে লেলিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের। তাদের উন্মত্ততায় রাজপথে বয়ে যায় রক্তের নদী।
এক পর্যায়ে আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। তীব্র জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা আর টিকতে পারেননি। পালিয়ে যান ভারতে। তার আগে-পরে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতা-কর্মী। এমনকি পুলিশ-প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাও গা-ঢাকা দেন। ওই আন্দোলন দমাতে প্রথম থেকেই বিতর্কিত ভূমিকায় ছিলেন পুলিশের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা।
আন্দোলনকারীদের হয়রানি, সমন্বয়কদের হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনসহ নির্বিচারে গুলি করে শত শত মানুষকে হত্যার নির্দেশদাতা ওই অতি উৎসাহী কর্মকর্তারাই এখন লাপাত্তা। তাদের অবস্থান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা গুঞ্জনও ছড়ানো হয়েছিল। খোদ পুলিশের মধ্যেই আছে নানা আলোচনা। কারও দাবি, তারা প্রশাসনের সহায়তায় দেশ ছেড়েছেন। কেউ ভেগেছেন আমেরিকায়, কাউকে আশ্রয় নিতে হয়েছে ভারতে। পলাতক এসব কর্মকর্তার মধ্যে আছেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, ঢাকা জেলার সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম প্রমুখ। এসব কর্মকর্তাসহ পুলিশের শীর্ষ অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলাও হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা কোথায় আছেন আর কেন আইনের আওতায় আসছেন না—সে বিষয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।