Image description

কখনো দুই হাত প্রসারিত করে চলাচল আটকাচ্ছেন, কখনোবা হাতের ইশারায় চলে যেতে বলছেন। কখনো কখনো হাতে থাকা লাঠি উঁচিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন। ঘটনা শুনে মনে হতে পারে হয়তো গরু-ছাগল চড়ানো কোনো রাখালের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা নয়। এভাবেই গরু-ছাগল চড়ানোর মতো যানবাহন তাড়াচ্ছিলেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্য।  কিন্তু ট্রাফিকের এসব নির্দেশনা সঠিকভাবে মানছেন না যানবাহন চালকরা। আর তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া অটোরিকশা চালকরা।

সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে রাজধানীর মোহাম্মপুরের বেঁড়বাধ মোড়ে। এখানেই দায়িত্বপালন করতে দেখা গেল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের তেজগাঁও বিভাগের এসআই মাহমুদুলকে। যানজট নিয়ন্ত্রণে চারটি সড়কের এই মিলনস্থলের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ছুটে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু বেপরোয়া অটোচালক ও বাসচালকদের বেশিরভাগই তার নির্দেশনা অমান্য করে কেউ সড়কের মাঝে দাঁড়িয়েই যাত্রী তোলায় ব্যস্ত, কেউবা চলার চেষ্টা করছিলেন উল্টোপথে।

যানবাহন চালকদের নির্দেশনা অমান্যের বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই মাহমুদুল আক্ষেপ করে চ্যানেল 24 কে বলেন, ‘আমার অন্ধের দেশে চশমা বিক্রি করি। যারা আইন জানেই না তাদের আইন মানানোর চেষ্টা করছি।’ এসআই মাহমুদুলের সঙ্গে কথা বলার সময়ই একটি অটোরকিশরা উল্টো রাস্তা দিয়ে এসে সিগন্যাল পার হওয়ার চেষ্টা করে। এসময় সেটিকে দেখিয়ে আরেক ট্রাফিক সদস্য বলেন, ‘এভাবে তাড়ালে গরু-ছাগলও কথা শুনতো মনে হয়। কিন্তু যানবাহন চালকরা কিছুই মানে না। শুধু সুযোগ খুঁজে আইন ভেঙে শর্টকার্টে যাওয়ার। আর এভাবেই যানজট লাগিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন: মোহাম্মদপুরে এত যানজটের কারণ কী, সমাধান কীভাবে

শুধু মোহাম্মদপুরেই নয়, ঢাকার অন্যান্য স্থানেও দেখা মেলে এমন দৃশ্যের। এরই মধ্যে গুলশানে অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করতে গিয়ে চালকদের বেপরোয়া আচরণের শিকার হয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। অটোচালকদের উশৃঙ্খল আচরণের হাত থেকে রেহায় পায়নি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অন্যান্য যানবাহনের চালকরা। এরইমধ্যে একে মোটরসাইকেল চলককে অটোরিকশার চালকদের মারধর ও প্যাডেলচালিত রিকশা ড্রেনে ফেলে দেয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশনা না মানার বিষয়ে জানতে চাইলে অটোরিকশা চালক মেহেদী হাসান জনি বলেন, সবাই যে মানে না তা না, অনেকেই মানে। তবে আগের মতো আর ট্রাফিকরে ভয় পায় না কেউ। এইখানে এখন সেনাবাহিনী থাকলে দেখতেন সবাই আইন মানতেছে।

বেপরোয়া যানবাহন চালকদের বিষয়ে জানতে রাজিব আহমেদ নামে বেসরকারি এক চাকরিজীবী চ্যানেল 24 কে বলেন, ‘অবাস্তব সড়ক পরিবহন আইন, অবৈধ  যানবাহন, অদক্ষ চালক, প্রকৌশলগত ত্রুটিযুক্ত অপ্রতুল রাস্তা এবং অনিরাপদ পথচারী পারাপারের অব্যবস্থাপনার দায়ভার নিতে হয় হাতের ইশারায় চালানো ট্রাফিক পুলিশকে৷ ফলে গরু-ছাগলের মতো যানবাহন তাড়ান ট্রাফিক পুলিশ।’

তিনি বলেন, বিশ্ব যেখানে ডিজিটাল সিগন্যাল এবং আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নতুনত্ব দেখিয়ে যাত্রী, যানবাহন ও চালকের পরিসংখ্যান নিরূপণ করে জনসেবায় যুগোপযোগী গণপরিবহন চালু করছে সফলভাবে, সেখানে বাংলাদেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবৈধ যানবাহন ও ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিক্যে সড়কের বিশৃঙ্খলা চরম যানযট সৃষ্টি করছে প্রতিনিয়ত।

তার মতে, গত ৮ মাসে সরকার সড়কে কোন শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি বরং নতুনভাবে সড়কে যুক্ত হয়েছে অনিবন্ধিত অবৈধ যানবাহন। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর সকল রাস্তা, ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজ দখল করে নিয়েছে একটি বিশেষ সিন্ডিকেটের হকাররা। এছাড়াও অপরাধীদের দৌরাত্ম ও চাঁদাবাজি বেড়েছে বহুগুণ। ঢাকা মহানগরীর অতি দুর্বল ও এনালগ ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। আর জনগণতো কোনভাবেই কোন আইন মানতে চায় না। ফলে প্রতিদিনই নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী যানযট ও সড়ক দুর্ঘটনা।’

ট্রাফিক পুলিশ যা বলছে:

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমানে অদক্ষ সদস্যদের দ্বারা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও নামমাত্র দেশীয় প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক  ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যক্রম রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই না। আগে এর চেয়েও আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার পরীক্ষামূলক ডিজিটাল সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা শুধু সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সফল হয়নি। এখনো অযোগ্য এই সিন্ডিকেট গত ৮ মাসে জনগণকে শুধু যানযট আর মূলসড়কে অবৈধ যানবাহন উপহার দিয়েছে। ফলে জনভোগান্তি চরমে পৌঁছে গেছে। আমরা সবাই এখন সড়কের বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের কাছে জিম্মি।  আর ব্যাটারিচালিত রিকশা বেপরোয়া গতিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে চলাচলের কারণে ছোট বড় অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে।’

যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) তানিয়া সুলতানা চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন,  আমরা আমাদের মতো করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন তা নেই। 

তিনি বলেন, আর অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে সেরকম কোনো নীতিমালাও নেই। অটোরিকশা উচ্ছেদে হাইকোর্টের একটা আদেশ ছিল, সেটাও কিন্তু উইথড্রো হয়েছে। তাই চাইলেই যে অটোরিকশা আমি সরিয়ে ফেলবো আমার সেরকম কোনো সুযোগ নেই। 

এডিসি তানিয়া সুলতানা বলেন, আমরা যখন অটোরিকশাগুলো সরাতে যাই তখন চালকদের সঙ্গে পুলিশের একটা হিচিং হয়। তারা পুলিশকে অ্যাসল্ট করেছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। এমন সব ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় কয়েকটি মামলাও হয়েছে। মানুষ এখন আইন মানতে চায় না। এরপরও ডাম্পিং করাসহ বিভিন্নভাবে আমরা এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। 

প্রতিদিন নতুন করে কী পরিমাণ অটোরিকশা সড়কে যুক্ত হচ্ছে, সেটা দেখভালের দায়িত্ব কার? এই প্রশ্ন করে তিনি বলেন, এই দায়িত্বতো ট্রাফিক পুলিশের না। আর বাসগুলো যে স্থানে থামার কথা বা যেখান দিয়ে ইউটার্ন নেয়ার কথা, সেই নির্দিষ্ট স্থান চালকেরা মানছেন না। এসব বাস আমরা মাঝেমধ্যে ডাম্পিংয়ে পাঠাচ্ছি। কিন্তু সবারই একটা সীমাবদ্ধতা থাকে। একসঙ্গে যখন অনেক বাসচালক ট্রাফিক আইন ভাঙছেন তখন তো সবার বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নিতে পাড়ছি না। যদি নেই তখন সেসব বাসের শ্রামিকরা আবার রাস্তা অবরোধ করতে পারে। তখনতো জনভোগান্তি সৃষ্টি হবে। 

তিনি বলেন, বাসচলাকরা খুব কম কথা শোনেন। মোহাম্মদপুর বিআরটিসির বাস ডিপোর সামনে গিয়ে দেখবেন প্রত্যেকটা বাস অর্ধেক বাইরে রেখে রাস্তা বন্ধ করে যাত্রী তোলে । সেখানেও আমি মামলা করেছি। এরপরও এসব বন্ধ হচ্ছে না। 

ট্রাফিকের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, আইন ভাঙার কারণে মামলা করতে গেলে মানুষ আমাদের সঙ্গে যেভাবে মিসবিহ্যাভ করে, তাতে মনে হয় সব দায়িত্ব আমার, সবকিছুর জন্যই আমি দায়ী। এসব নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য স্টেকহোল্ডার যারা আছেন যেমন বিআরটিএ বা সিটি করপোরেশন তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও সাধারণ মানুষেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে।  কিন্তু কেউ বিন্দু পারিমাণ কোনো রোল প্লে করে না। সবারইতো উচিত কিছু কাজ করা। ’

তিনি বলেন, প্রত্যেকেরই আইন মানার কথা, কিন্তু কেউ আইন মানছেন না। সবারইতো আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। প্রতিটা বাসেই অনেক যাত্রী থাকেন। বাসচালক যখন আইন ভাঙেন তখন কিন্তু কোনো যাত্রীই তাকে নিষেধ করেন না।  জনগণ যেদিন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে সেদিনই আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। কারণ আমরা তো আর হাতে লাঠি তুলে নিতে পারবো না। ’      

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা:

সড়কের বিশৃঙ্খললা ও চালকদের বেপরোয়া আচরণের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক চ্যানেল 24 বে বলেন,  ‘সড়ক বা পরিবহনের সাথে যতগুলো প্রতিষ্ঠান জড়িত, বিশেষ করে বিআরটিএ এমন সব প্রতিষ্ঠানেরই আমূল পরিবর্তন করতে হবে।  সড়কে কোন গাড়ি চলবে তার রেজিস্ট্রেশন দেয় বিআরটিএ। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানা লোক নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজের দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা নাই। দায়হীনভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে। আপনি যানজটের জন্য শুধু পুলিশকে কেন দোষ দিবেন?

তিনি বলেন, সড়কে কে চলছে না চলছে তার ব্যপারে উদাসীন বিআরটিএ। তার মানে সমস্যাটা তৈরি করছে তারা। আজকের (সোমবার ২১ এপ্রিল) হিসেবেও ৩৬০টা গাড়িকে সড়কে চলার রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে বিআরটিএ।  এই গাড়িগুলোকে রেজিস্ট্রেশন দেয়ার সময় বিআরটিএ কী একবারও ভেবেছে তারা চলবে কোথায়?

‘সড়কে যত গাড়ি চলতে পারবে তার চেয়েও বেশি সংখ্যায় রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে বিআরটিএ। তার ওপর আছে অবৈধ যানবাহন।  এসব বিষয়ে বিআরটিএকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বলে আমাদের লোকবল কম। তাহলে যে প্রতিষ্ঠানের কাজ করার সামর্থ্য নেই, প্রয়োজনীয় লোকবল নেই সেই প্রতিষ্ঠান চালছে কেন? এটাতো বন্ধ করে দেয়া উচিত।  তা না হলে এর কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে, যাতে সে কাজ করতে পারে এবং দায়িত্ব নেয়।  আমাদের সড়কের সমস্যার মূল কারণ হলো রেগুলারিটি অথরিটিগুলো অক্ষম। এজন্য শুধু পুলিশকে দোষ দিলেই হবে না। অল্প রাস্তায় এত সংখ্যক গাড়ি চলার অনুমতি দিলে পুলিশ সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে কীভাবে?’ বলেন তিনি।   

বুয়েটের এই শিক্ষক আরও বলেন, ছাত্ররা যখন রাস্তায় নেমেছিল তখনও মানুষ আইন মেনেছিল। সেনাবাহিনী এসে দাঁড়ালেও মানছে। কিন্তু এভাবে আইন মানানোতো টেকসই হবে না। কারণ রাস্তায় যখন ধারণক্ষমতার বেশি যানবাহন চলবে তখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবেই। তাই টেকসই সড়ক ব্যবস্থার জন্য রেগুলারিটি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো খুবই জরুরি। এজন্য তাদের কাঠামোগত আমূল সংস্কার করতে হবে। আর এটা কোন গণতান্ত্রিক সরকার করবে না রাজনৈতিক কারণে,  এই সরকারকেই করতেই হবে। 

অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, অটোর সমস্যাটা জটিল করে গেছে আগের সরকার।  তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকার জন্য চালকদের আন্দোলনের মুখে বলে দিলেন অটো চলবে।  তখন পুলিশ কিন্তু বলার চেষ্টা করেছিল অটো চলুক, কিন্তু প্রধান সড়কে নয়। তা না করে অটোগুলোকে দিয়ে দেয়া হলো ব্ল্যাংকচেক। তাহলে অটোচালকরা পুলিশের কথা শুনবে কেন?

তিনি বলেন, এই সরকারের সামনে একটা সুযোগ ছিল অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণের। শিক্ষার্থীরা সরকারকে সেই সুযোগ করে দিয়েছিল। এই সরকারের অন্তত বলার সুযোগ ছিল যে আগে অন্যায়ভাবে অটো চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আমরা এটা চাই না, এই ধরণের যানবাহন প্রধান সড়কে চলবে না। আদেশটা দিতে এই সড়কারেরও কেন এত দ্বিধা হয় আমি এটা বুঝি না।  সরকার যদি ঘোষণাটা দিত তাহলেও কিন্তু পুলিশের হাতটা একটু শক্ত হতো। পুলিশ বলতে পারতো যে রাস্তায় বাস চলে সেখানে অটোরিকশা বিচরণক্ষেত্র হবে না।  তারা আইনগতভাবে শক্ত অবস্থানে যেতে পারতো।