Image description

পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদসহ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়ার প্রধান পাঁচটি শহরে পাঁচ বছর আগে গ্যাসের সিস্টেম লস (সঞ্চালন ও ডিস্ট্রিবিউশন) ছিল গড়ে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদসহ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়ার প্রধান পাঁচটি শহরে পাঁচ বছর আগে গ্যাসের সিস্টেম লস (সঞ্চালন ও ডিস্ট্রিবিউশন) ছিল গড়ে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। মূলত পাইপলাইন লিকেজ, চুরি ও কারিগরি ত্রুটিজনিত কারণে এটি হতো। তাই গ্যাস খাতে আর্থিক ক্ষতি কমাতে এ পাঁচ শহরে ১ হাজার ৪৭০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করে পাকিস্তান সরকার। গ্যাস রক্ষণাবেক্ষণে বসানো হয় টাউন বর্ডার স্টেশন (টিবিএস)। এতে শহরগুলোয় গ্যাসের সিস্টেম লস ক্রমান্বয়ে ৫ দশমিক ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সামগ্রিক হিসাবে দেশটির গ্যাস খাতের সিস্টেম লস এখন ৫ শতাংশের কিছু বেশি। টিবিএস প্রযুক্তি পুরনো পাইপলাইনে লিকেজ চিহ্নিতকরণ, চুরি বন্ধ করা, ছোট এলাকায় লিকেজ মেরামত এবং গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ শনাক্ত করতে বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।

পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রদেশভেদে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণে বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। গ্যাস পাইপলাইনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তাদের প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ খাতে সিস্টেম লস গড়ে ৩-৪ শতাংশের বেশি নয় বলে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে উঠে এসেছে। মূলত গ্যাস খাতে সিস্টেম লস নির্ধারণ করে ভারত সরকারের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (পিএনজিআরবি)। পাইপলাইনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, নকশা, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে দক্ষতার কারণে ভারতে সিস্টেম লস এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ পর্যন্ত। তবে এ লোকসান শুধু কারিগরি ত্রুটিজনিত কারণে হয়।

অথচ বাংলাদেশে গ্যাসের সিস্টেম লস ভারতের তিন গুণ ও পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ। সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস অভাবনীয় হারে বেড়ে যাওয়ায় প্রতি বছর ১ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে দেশের গ্যাস খাতে। মূলত পুরনো পাইপলাইন, লিকেজ, চুরি ও অপরিকল্পিত অবকাঠামোর কারণে কারিগরি ত্রুটিতে বাড়ছে এ ক্ষতির পরিমাণ।

দেশে পাইপলাইনে গ্যাস বিতরণ করে ছয়টি কোম্পানি। এসব কোম্পানির মধ্যে বেশির ভাগ গ্রাহক তিতাসের। কোম্পানিটির আওতায় মোট ২৮ লাখ ৮৩ হাজারের বেশি গ্রাহক রয়েছে (২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাবে)। গ্রাহক ও গ্যাসের ব্যবহারভেদে তাদের সিস্টেম লস জানুয়ারির হিসাবে ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এর বাইরে বাকি পাঁচটি কোম্পানির গ্রাহক সংখ্যা সীমিত।

জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্যাসের ব্যবহার ও গ্রাহক বিবেচনায় বিতরণ পর্যায়ে সিস্টেম লস এখন ১১ শতাংশের কাছাকাছি। যদিও বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, সিস্টেম লস এখন গড়ে সাড়ে ১০ শতাংশের মতো।

বিতরণকারী কোম্পানি তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‌‌‘গ্যাসের সিস্টেম লস কমাতে রোডম্যাপ দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। সেখানে সিস্টেম লসের একটা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এগুলো মোকাবেলা করেই তিতাস সিস্টেম লস সন্তোষজনক অবস্থানে নামিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।’

জ্বালানি বিভাগের এক হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছর বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে। বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সিস্টেম লস যথাক্রমে ১০ দশমিক ৫৩ ও ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিস্টেম লসের নামে এ গ্যাসের সিংহভাগ চুরি হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া কারিগরি ত্রুটি ও অপরিকল্পিত পাইপলাইন নির্মাণের কারণেও গ্যাস খাতে সিস্টেম লস কম নয়। তবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার আর দক্ষতা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশে সিস্টেম লস ৩-৪ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব।

জ্বালানি বিভাগের প্রকাশিত রোডম্যাপে দেখা গেছে, দেশের গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে এ উদ্যোগের বাইরে থাকছে তিতাস ও বাখরাবাদ কোম্পানি। পুরনো পাইপলাইন ও অবৈধ সংযোগ বিবেচনায় তিতাস ও বাখরাবাদের সিস্টেম লস সর্বনিম্ন ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে।

গ্যাস খাতের সিস্টেম লসে প্রতি বছর আর্থিকভাবে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে সরকারের। এ ক্ষতির কারণে এ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কারিগরি ক্ষতির নামে গ্যাস অপচয় হয়েছে ১৩৭ কোটি ঘনমিটার। এলএনজি আমদানি ও সরবরাহে পেট্রোবাংলার খরচ প্রতি ঘনমিটারে ৭৯ টাকা ৩৪ পয়সা। এ হিসাবে গ্যাস অপচয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা বেশি।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে রোডম্যাপ তৈরি করে দেয়। সেই রোডম্যাপ অনুযায়ী সফলতাও মিলছে। চলতি বছরের তিন মাসের তথ্য বিশ্লেষণে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সিস্টেম লস সন্তোষজনক মাত্রায় কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কোম্পানিগুলোর জন্য যেমন পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তেমনি ব্যর্থ হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও রেখেছে জ্বালানি বিভাগ।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসের সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে আমরা একটা রোডম্যাপ তৈরি করেছি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রত্যেকটি বিতরণ কোম্পানিকে সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে হবে। সিস্টেম লস কমিয়ে আনা কোম্পানিগুলোর জন্য পুরস্কার দেয়া হবে। যারা ব্যর্থ হবে তাদের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রয়েছে। গ্যাসের সিস্টেম লসের বড় একটি অংশ অপচয়। এ অপচয় রোধে সফটওয়্যার ডেভেলপ করা হচ্ছে। এছাড়া অভিযান চালাতে ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করবেন।’

গ্যাস খাতের সিস্টেম লসের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্য মাত্রা বিতরণ খাতে দশমিক ২০ থেকে দশমিক ৩০ শতাংশ। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুরনো পাইপলাইন ও লিকেজ বিবেচনায় স্থানীয়ভাবে আদর্শিক সিস্টেম লস বিবেচনা করা হয় ২ শতাংশ। যদিও এখন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিতরণ কোম্পানিগুলোকে সিস্টেম লসের হার বিবেচনায় ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছে।

বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মো. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসের আদর্শিক সিস্টেম লস ২ শতাংশ। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সব কোম্পানিকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সিস্টেম লস অনেক বেশি। তাদের এক বছরের মধ্যে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।’

দেশের গ্যাস খাতে সিস্টেম লসের ফলে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি কমিয়ে আনতে জোর তাগিদ দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, বর্তমান সরকার গ্যাস খাতের দক্ষতার ওপর জোর দিলে আর্থিক ক্ষতি কমে আসবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে গ্যাসের সিস্টেম লসের বড় একটি অংশ চুরি। এ চুরি ঠেকাতে সরকারকে কৌশল অবলম্বন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কারিগরি অপচয়, যেটাকে সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো হচ্ছে। গ্যাস খাতের দক্ষতা বাড়িয়ে এ ধরনের অপচয় কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গ্যাস উৎপাদন-সঞ্চালন ও বিতরণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সিস্টেম লস কমিয়ে এনেছে। আমাদের এ খাতে দক্ষতা ও উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। সিস্টেম লস কমানো গেলে গ্যাস খাতের বিপুল পরিমাণ ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব। সরকারের এ জায়গায় অনেক বেশি কাজ করা প্রয়োজন।’