Image description

বর্তমানে শহরাঞ্চলের বেশির ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গরিবের স্কুল হিসেবে পরিচিত। আর মফস্বলেও ব্যতিক্রমী কিছু স্কুল ছাড়া শিক্ষার্থীরা কিন্ডারগার্টেনের দিকে ছুটছে। সরকারি স্কুলে গেলেই দেখা যায়, নোংরা পরিবেশ, নিয়মিত ঝাড়ু দেওয়া হয় না, শ্রেণিকক্ষে ফ্যান নেই, দেয়ালের অবস্থা যাচ্ছেতাই, বাথরুম নোংরা, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই, এমনকি চক-ডাস্টার পর্যন্ত নেই। ফলে যেসব অভিভাবকের সামর্থ্য রয়েছে, তাঁরা সরকারি স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করতে চান না।

অথচ সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় প্রতিবছর স্কুল লেভেল ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান (স্লিপ) ফান্ডের আওতায় প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা দেয়। এর বাইরে যেকোনো রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামতসহ অন্যান্য কাজে প্রয়োজন অনুসারে আলাদা অর্থ বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে কন্টিজেন্সি বিল, রুটিন মেরামত, বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে বরাদ্দ, টয়লেট পরিষ্কারসহ নানা খাত রয়েছে। এ ছাড়া স্কুল ম্যানেজিং কমিটিরও (এসএমসি) আর্থিকসহ যেকোনো প্রয়োজনে বিদ্যালয়কে সহায়তা করার কথা। তবে স্লিপ ফান্ডের এত বিপুল অর্থ বরাদ্দের কথা অভিভাবকসহ এলাকার সাধারণ মানুষের অনেকেই কিছু জানে না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছর স্লিপ ফান্ডের বরাদ্দের ৪৮০ কোটি টাকার প্রায় অর্ধেকই লোপাট হয়। বেশির ভাগ প্রধান শিক্ষকই এই অর্থ লোপাটের হোতা। তাঁরা বরাদ্দের পরপরই নানা খাত দেখিয়ে টাকা খরচ হয়ে গেছে বলে জানান। অনেক স্কুলেই প্রধান শিক্ষকের এই কাজের সহযোগী থাকেন এসএমসির দু-একজন সদস্য। তবে হাতে গোনা কিছু প্রধান শিক্ষক এই অর্থের সদ্ব্যবহার করেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, স্লিপের টাকার সঠিক ব্যবহার করতে আমি কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছি। কেউ যাতে এই টাকায় কুদৃষ্টি না দেয়, সে বার্তা আমি স্কুলে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছি। এ ছাড়া এই টাকার যথাযথ ব্যবহার যাতে হয় তা মনিটর করতে শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমি নিজেও কিছুদিন ধরে দায়িত্ব নিয়েছি। কিছুদিন পরে বুঝতে পারব স্লিপের টাকার কতটুকু সদ্ব্যবহার হচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের ৫১৩টি উপজেলার ৬৫ হাজার ৫৩১টি বিদ্যালয়ে দুই দফায় ৪৮০ কোটি ৩৫ লাখ ৯৯ হাজার ৭২৮ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেসব স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫০ জনের মধ্যে, তারা বরাদ্দ পেয়েছে ৫০ হাজার টাকা। ৫১ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর স্কুলে এক লাখ, ৩০১ থেকে ৬০০ শিক্ষার্থীর স্কুলে দেড় লাখ, ৬০১ থেকে এক হাজার শিক্ষার্থীর স্কুলে দুই লাখ এবং এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর স্কুলে আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। 

গত ১৬ মার্চ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। সেখানে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ৩ নম্বর গট্টিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্লিপ ফান্ডের বরাদ্দ করা অর্থ লুটপাটের চিত্র তুলে ধরা হয়। ওই স্কুলে ২০২৪ সালে প্রকৃত ছাত্রছাত্রী ছিল ২৮৫ জন। হাজিরা খাতায় দেখানো হয়েছে ২৯৭ জন এবং মাসিক রিটার্নে দেখানো হয়েছে ৩১২ জন।

অভিযোগে বলা হয়েছে, যেহেতু ৩০০-এর বেশি শিক্ষার্থী থাকলে স্লিপ ফান্ডের বরাদ্দ বেশি পাওয়া যায়, তাই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে চৌর্যবৃত্তি করার জন্য প্রধান শিক্ষক পূর্ণিমা রানী পাল নিজেই ভুয়া ছাত্রছাত্রীর নাম হাজিরা খাতায় তোলেন। সহকারী শিক্ষকদের তা সারা বছর টেনে যেতে বলেন। তাঁরা অস্বীকৃতি জানালে নানা হুমকিও দেন। যেমনতৃতীয় শ্রেণিতে হিরা আলী (রোল-৬৩), সিহাব আলী (রোল-৬৪), সোহানুর (রোল-৬৫) দেখানো হয়েছে। আবার তাদের নাম চতুর্থ শ্রেণিতেও রয়েছে।

অভিযোগে আরো বলা হয়, ২০১৯ সালের পর এই স্কুলে কোনো টেবিল-চেয়ার কেনা হয়নি। অথচ এই স্কুলে এ বছর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বাবদ তিন হাজার ৬০০ টাকা এসেছে। কিন্তু প্রধান শিক্ষক সেখান থেকে তা খরচ না করে মেরে দিয়েছেন। এ ছাড়া রুটিন মেরামতে ৪০ হাজার, ওয়াসব্লকে ২০ হাজার টাকা এসেছে, কিন্তু এর কিছুই খরচ করেননি। এ বছর স্লিপ ফান্ডে এক লাখ চার হাজার টাকা বরাদ্দ পেলেও সেখান থেকে কিছুই খরচ না করে মেরে দিয়েছেন। শুধু এই স্কুল নয়, দেশের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ স্কুলের একই অবস্থা। সরকার যদি স্লিপ ফান্ডের এই অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়, তাহলেও স্কুল একইভাবে চলবে।

৩ নম্বর গট্টিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পূর্ণিমা রানী পালের কাছে স্লিপের টাকার যথাযথ ব্যবহার না করা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, সরাসরি স্কুলে না এলে কোনো কথা বলব না। এরপর তিনি ফোন কেটে দেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্লিপ ফান্ডের অর্থ সরকার একটি অর্থবছরে দুই ভাগে ভাগ করে বরাদ্দ করে। সাধারণত প্রথম ও দ্বিতীয় ছয় মাসের শেষ দিকে বরাদ্দ করা হয়। ফলে এই অর্থ লোপাটের একটা সুযোগ তৈরি হয়। শেষ সময়ে আসা টাকা কোনো রকম বিল-ভাউচার করে তা তাড়াহুড়োর মধ্যে খরচ দেখানো হয়। আবার বেশির ভাগ এসএমসির সভাপতি তাঁদের নিজস্ব কাজে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকায় তাঁরা স্কুলের তেমন খোঁজখবর নেন না। ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো চলে সাধারণত প্রধান শিক্ষকের কথায়। আর তিনি সরকারি চাকরি করেন বলে চাকরিরও কোনো সমস্যা হয় না। তবে প্রধান শিক্ষক সাধারণত থানা শিক্ষা অফিসার (টিইও) ও সরকারি থানা শিক্ষা অফিসারকে (এটিইও) ম্যানেজ করে চলেন। এই স্লিপের টাকার ভাগ তাঁদেরও দিতে হয়। এ ছাড়া টাকা ছাড়ের সময় অ্যাকাউন্টস অফিসকেও ঘুষ দিতে হয়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় স্লিপ ফান্ডের অর্থের সদ্ব্যবহারে বিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নির্দেশিকা ২০২৩ নামে একটি নীতিমালা জারি করে। সেখানে স্লিপ ফান্ডের ব্যয়যোগ্য খাত হিসেবে বলা হয়, শিখন-শেখানো সামগ্রী ক্রয়; অবকাঠামো ও আসবাব মেরামত, বার্নিস, রং করা ইত্যাদি; বিভিন্ন দিবস উদযাপন, আইসিটি সামগ্রী মেরামত, কিট-কালি ক্রয় ও ইনস্টলেশন কার্যক্রম; অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি ক্রয়, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক সামগ্রী ক্রয়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী ক্রয়, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নসংক্রান্ত কার্যক্রম, শ্রেণিকক্ষ সজ্জিতকরণ, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ; হোয়াইট বোর্ড, মার্কার, লাইট, রেজিস্ট্রার, চক, ডাস্টার, বিন, স্টেশনারি ইত্যাদি ক্রয়; পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্রপাতি ও ফিল্টার ক্রয়, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ বনায়ন ও সবুজায়ন, ফ্যান-লাইট ক্রয়, কাব স্কাউটসের জন্য অপরিহার্য দ্রব্যাদি ক্রয় ও ফি পরিশোধ ইত্যাদি।

নীতিমালায় স্লিপ ফান্ডের অর্থে হোয়াইট বোর্ড, মার্কার, কলম, বাল্ব, লাইট, রেজিস্টার কেনা ও ক্ষুদ্র মেরামতকে অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে। আসবাব কেনাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় অনুদানের মাধ্যমে বিদ্যালয়ে স্লিপ তহবিল গঠন করা যাবে বলেও বলা হয়েছে। স্লিপ ফান্ডের অর্থ ব্যয়ে প্রধান শিক্ষককে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করে ঢাকার একজন থানা শিক্ষা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, স্লিপের টাকার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। টাকা ছাড় করতেই ঘুষ দিতে হয়। এরপর আরো অন্যদেরও দিতে হয়। আর বেশির ভাগ প্রধান শিক্ষকই স্লিপের অর্থের বড় অংশ নিজেই নিয়ে নেন। খুব সামান্যই স্কুলের কাজে ব্যয় হয়। অথচ এই টাকা দিয়ে একটি স্কুল সুন্দরভাবে চালানো সম্ভব। একটি স্কুলে গেলেই বোঝা যাবে ওখানে স্লিপের টাকার সদ্ব্যবহার হচ্ছে কিনা। এ ব্যাপারে কঠোর মনিটরিং জরুরি।