Image description

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রেমিক যুগলের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ধরনের প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। তাদের চক্রান্তের জাল এত বড় এবং নিখুঁত যে সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এমনকি খোদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও প্রতারণা থেকে রেহাই পায়নি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জুলফা নামের এক ভুক্তভোগী অভিযোগ দিলে তদন্তে নামে প্রশাসন। পরে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে এ যুগলের কুকর্মের ইতিহাস। 

অভিযুক্ত ঐ যুগলের একজনের নাম জান্নাতুল ফেরদৌস শ্রাবণী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী; থাকেন কবি সুফিয়া কামাল হলে। অন্যজন তার প্রেমিক রাকিবুজ্জামান শুভ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী; থাকেন কবি জসীম উদ্দীন হলে। এখন পর্যন্ত এই প্রেমিক যুগলের বিরুদ্ধে ২৮টি প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশের তথ্যপ্রমাণ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, জান্নাতুল ফেরদৌস শ্রাবণী প্রথমে ভুক্তভোগী জুলফা নামের শিক্ষার্থীর সাথে সখ্যতা গড়েন। হলের বড় বোন হিসেবে শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবেই শ্রাবণীকে মনে করতেন। এরপর কোন একদিন শ্রাবণী জুলফাকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘তোমার নামে একটা বৃত্তির আবেদন করব। তোমরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছবি তুলে দাও।’ কাগজপত্র হাতে পেয়ে জুলফা আক্তার নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলেন শ্রাবণী; সাথে হোয়াটসঅ্যাপ একাউন্টও। এরপর ২৪ সালের মার্চ মাসে সিলেটে বন্যা শুরু হলে তিনি জানতে পারেন জুলফাদের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি জুলফা থেকে তার বাড়ির ছবি চেয়ে নেন। এর পরেই শুরু হয় তার প্রতারণা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্যতম ফেসবুক গ্রুপ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ’। এ গ্রুপে শ্রাবণী নামবিহীন (এনোনিমাস) করুণ ছবি পোস্ট দিয়ে তার সাথে বিকাশ নাম্বার যুক্ত করে সাহায্য চাইতে থাকেন। একইভাবে ওই বছরের জুন-জুলাইয়ে সিলেটে পুনরায় বন্যা দেখা দিলে ফের বাবার দোকান ডুবে যাওয়া ও ঘর ডুবে যাওয়ার কথা বলে টাকা সংগ্রহ করেন। তথ্য বলছে, দুই দফায় তিনি ত্রিশ হাজারেরও বেশি টাকা উত্তোলন করেন। এসময় তাকে বন্যার্তদের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রক্টর ডা. আব্দুল মুহিত থেকে পাঁচ হাজার এবং রেদওয়ানুল ইসলাম নামের এক আমেরিকা প্রবাসী ও ঢাবির সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে তিন হাজার টাকা নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।

পরের ধাপে অভিযুক্ত শ্রাবণী শুরু করেন ভিন্ন প্রতারণার কৌশল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার ভবন সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত জান্নাতুল ফেরদৌস শ্রাবণী ভুক্তভোগী জুলফার নাম, আইডি কার্ড ও সার্টিফিকেট ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণ তহবিল থেকে গত বছরের ১৪ অক্টোবর ৪০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। টাকা উত্তোলনের সময় তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানান জুলফার বাচ্চা থাকায় তিনি আসতে পারছেন না। তাই তিনি তার হয়ে কাজ করছেন। এদিকে নিজ নামেও একই বছরের মার্চ মাসে ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন শ্রাবণী।

বসুন্ধরা শুভসংঘের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া শুরু হলে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী শ্রাবণী নানাভাবে তদবির শুরু করেন। এবারও তিনি দারিদ্র্যসহ নানা সমস্যার কথা জানিয়ে একেকভাবে জুলফার পরিচয় ব্যবহার করে এখান থেকে মাসে ৩ হাজার টাকা করে বৃত্তি নেন। নেকাব-বোরকা পরায় এখানে কোনো রকমের পরিচয় শনাক্ত ছাড়াই বৃত্তি পান তিনি। এছাড়া মোরাল প্যারেন্টিং নামের একটা সংগঠন থেকেও টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। 

জানা যায়, অভিযুক্ত শ্রাবণী নিজ বিভাগ উর্দুর ২০২২-২৩ সেশনের আয়েশা নামের আরেক শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে আয়েশা টাকার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছেন না এমন কথা বলে ‘পে ইট ফরওয়ার্ড’ নামক একটি সংগঠন থেকে ১৫ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। তার এই প্রতারণার জাল থেকে রক্ষা পায়নি ছাত্রলীগও। আয়েশার ভর্তির নাম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের কাছ থেকেও সেই সময় ৮ হাজার টাকা আদায় করেন তিনি।

অভিযুক্ত শ্রাবণীর জুলাই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততার কথা না জানা গেলেও জুলাইযোদ্ধা সেজে তৎকালীন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম থেকে পুরস্কার নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অভিযোগ রয়েছে ফেসবুক গ্রুপে এক মহিলার ছবি পোস্ট করে তাকে মেসের বুয়া হিসেবে পরিচয় দিয়ে জুলাই আন্দোলনে আহত সাজিয়ে টাকা সংগ্রহ করেছেন শ্রাবণী। বুয়ার নাম করে জহুরুল হক হলের ইমতিয়াজ আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থী থেকে ১৫ হাজার টাকা নেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। টাকা উত্তোলনের হালনাগাদ তথ্য জানাতে গিয়ে তিনি ঐ পোস্টের কমেন্টে জানান, ওই বুয়া চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করেছেন তিনি। সাথে একটি মোবাইল ফোন, জোড়া ছাগল ও কোন এক মাধ্যমে মাসিক তিন হাজার টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। তবে আদৌ এমন কেউ আছে কি না বা থাকলেও তিনি মেসের বুয়া কি না তা জানা যায়নি।

শ্রাবণী নিজ মাকে গৃহ শ্রমিক পরিচয় দিয়ে ‘শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ থেকে ৪০ হাজার টাকা উত্তোলনের তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।  এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসে চাকরি করা এক কর্মকর্তার থেকেও নানা অযুহাতে টাকা হাতিয়ে নেন শ্রাবণী। আসিফ নেওয়াজ নামের ঐ কর্মকর্তা থেকে বাবা মারা গেছেন, মা অসুস্থ, ভাই বেকার, ভর্তি হওয়ার টাকা নেই, খাবারের টাকা নেই এমন নানা অযুহাতে কয়েক দফায় ১৫-১৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন ওই শিক্ষার্থী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব কাজে সহায়তা করলেও এর পিছনে মূল মাস্টারমাইন্ড তার প্রেমিক রাকিবুজ্জামান শুভ। দুজনেই সম্মিলিতভাবে এমন প্রতারণা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবন ঘুরেঘুরে শ্রাবণীর হয়ে কল্যাণ তহবিলের কাগজ এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে যাওয়ার জন্য সব ধরনের তোড়জোড় এই শুভই করতেন। এছাড়া নিজের নামে গত বছরের ১৬ অক্টোবর কল্যাণ তহবিল থেকে ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন তিনি। 

তদন্ত বলছে, অভিযুক্ত শুভ ব্যবসার কথা বলে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে নাহিদ ইসলাম নামের তার এক সহপাঠী থেকে ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। একেকভাবে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মুসা আব্দুল্লাহ রায়হান নামের আরেক শিক্ষার্থী থেকে ৩৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। তবে এর মধ্যে ১৩ হাজার টাকা তিনি পরিশোধ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থী ফয়েজ আহমেদ থেকে ব্যবসার কথা বলে ৮ হাজার টাকা নিয়ে আর ফেরত দেননি শুভ। আরো অভিযোগ রয়েছে, অনলাইন প্রতারণায় জড়িয়ে মামলাও রয়েছে শুভর নামে। যদিও পরে এক বড় ভাইয়ের সহায়তার মামলা থেকে উদ্ধার হন তিনি। এছাড়া  মো. শাহিন হোসেন নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ব্যবসার অযুহাতে ২০ হাজার হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

শুভকে ৩৩ হাজার টাকা দেওয়া ভুক্তভোগী মুসা আব্দুল্লাহ রায়হান বলেন, ‘সে কাপড় আর জুস বারের ব্যবসা করবে বলে আমার থেকে ৩৩ হাজার টাকা নেয়। আমি তার ব্যবসার শেয়ার হোল্ডার হিসেবে সে কখনও আমাকে কখনও হিসেব দিত না। বললে বলতো, আরে মামা ব্যবসা করি; চলতেছে। কয়েকদিন পরে এসে বলে লস খেয়েছে। তাকে অনেকবার বলার পরে কয়েক দফায় ১৩ হাজার টাকা দেয়। এখনও ২০ হাজার বাকি। আমি বাড়িতে আছি। কালকে ক্যাম্পাসে ফিরে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ জমা দিব।’

শুভর প্রতারণার সাক্ষী তার হলের সিনিয়র নূরুল আমিন বলেন, ‘আমার গ্রামের এক ছেলের সাথে অনলাইনে প্রতারণা করেছে শুভ। পরে বিষয়টি মামলাতেও গড়ায়। কিন্তু আমি মধ্যস্থতা করে টাকা নিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলে ভুক্তভোগী মামলাটা উঠিয়ে নেয়। কিন্তু পরে সে আমার সাথেও প্রতারণা করে। নানা অযুহাতে সে আর টাকা দেয়নি। এই ঘটনা নিয়ে কথা চলাকালীন এই ছেলের বিরুদ্ধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবং এরকম আরো একাধিক জালিয়াতি করার কথা শুনেছিলাম।’ 

শ্রাবণীর প্রতারণা শিকার ভুক্তভোগী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জুলফা বলেন, ‘হলের একটা ইফতার প্রোগ্রামে তিনি আমাকে বলেন তুমি তোমার কাগজপত্রগুলো দিয়ো একটা বৃত্তির আবেদন করবো। আমার কাছে বৃত্তি আছে। এর পরে আমার নাম করে আমার থেকে বন্যার ছবি নিয়ে গ্রুপে পোস্ট করে টাকা নেওয়া, কল্যাণ তহবিল থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া, আমার নামে বৃত্তি নেওয়া সব উনি করছেন। গ্রুপে উনার এ সব পোস্ট আমি দেখতাম না। কারণ, তিনি আমাকে ব্লক করে রেখেছেন।’

প্রতারণার শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা মো. আসিফ নেওয়াজ বলেন, ‘আমি তার আবেগঘন পোস্ট দেখে সেচ্ছায় নক দিই। সে জানায় তার খাওয়ার টাকা নেই। ভর্তির টাকা নেই। স্বাভাবিকভাবেই আমি তাকে বিশ্বাস করে কয়েক দফায় আমার সাধ্যমতো টাকা দেই। কিন্তু এখন জানলাম সে প্রতারক।’ 

পে ইট ফরোয়ার্ডে শ্রাবণীকে বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া সংগঠনটির মডারেটর আবু বকর বলেন, ‘জান্নাতুল ফেরদৌস শ্রাবণীকে হতদরিদ্র মনে করেই বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে যে প্রতারক তা আমাদের জানা ছিল না। সে বিভিন্ন কারণ দেখে আমাদের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছিল। প্রতারণা করে বৃত্তি নিয়ে ধরা পড়ার পর তার বৃত্তি বাতিল করা হয়। কান্নাকাটি করে মাফ চেয়েছিল বলে আর কোনো শাস্তি সে দেয়নি। এখন শুনতেছি সে আরো বিভিন্ন জায়গা থেকে এরকম প্রতারণা করে টাকা নিয়েছেন।’ 

প্রতারণার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিন ফিউচার ফাউন্ডেশন থেকে তাদের দুজনকেই বহিষ্কার করা হয়। এ বিষয়ে সংগঠনের নির্বাহী প্রধান খালিদ হাসান বলেন, ‘সে একজন প্রতারক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত করার পর তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। যেহেতু সে প্রতারণা করেছে সেহেতু তাকে গ্রিন ফিউচার থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’ 

প্রেমিক যুগলের এমন প্রতারণার ঘটনা প্রশাসনের নজরের আসাতেই অভিযুক্ত দুজনের মুঠোফোন জব্দ করে কর্তৃপক্ষ। ফলে জান্নাতুল ফেরদৌস শ্রাবণীর কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে রাকিবুজ্জামান শুভর সচল ভিন্ন একটা নাম্বারে যোগাযোগ করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. সালমা নাসরিন বলেন, ‘প্রক্টর অফিস থেকে এ বিষয়ে আমাদের জানানো হয়েছে। তবে বিস্তারিত জানানো হয়নি। আমাদের বলা হয়েছে, সে যেন মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে। সে সার্বিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক বিষয়টা জানার জন্য বলা হয়েছে। সে আপাতত হলেই রয়েছে।’ 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমার জানা মতে তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ২৮টা অভিযোগ জমা পড়েছে। সহকারী প্রক্টর শারমীন কবীরকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিষয়টা এখনও তদন্তাধীন।’