Image description
রেল পুলিশের তথ্য । প্রতি মাসে গড়ে ৮৫ লাশ । লাইনের ওপর বসে থাকা ও চলাচলে কাটা পড়ে মৃত্যু ৫০% । অসতর্কভাবে লেভেলক্রসিং পারাপারে মৃত্যু ২৭% ।

সারা দেশে রেললাইন থেকে ২০২৪ সালে এক হাজার ১৭টি লাশ উদ্ধার করেছে রেলওয়ে পুলিশ। সেই হিসাবে রেললাইন থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৮৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৭৯৪ জন পুরুষ এবং ২২৩ জন নারী। এসব লাশ উদ্ধরের ঘটনায় ৯৯৮টি অপমৃত্যুর মামলা করা হয়েছে।

 
এর মধ্যে তদন্ত শেষে ছয়টি মামলা খুনের মামলায় রূপান্তরিত হয়। রেলওয়ে পুলিশের সদর দপ্তর থেকে পাওয়া ডেটা বিশ্লেষণে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

 

রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫০৪ জন, অর্থাৎ ৫০ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে রেললাইনে বসে থাকা ও চলতে থাকা অবস্থায় চলন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে। অসতর্কভাবে লেভেলক্রসিং পার হওয়ার সময় মৃত্যু ২৭২ জনের, যা ২৭ শতাংশ।

 

 

অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের রেলপথের অনেক লেভেলক্রসিং অরক্ষিত থাকাটা রেললাইনে মৃত্যুর অন্যতম কারণ।

রেলওয়ে পুুলিশের তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, গত বছর ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ২৩ জন, ইয়ারফোন লাগিয়ে রেললাইনে চলাচল করতে থাকা অবস্থায় ও অন্যান্য কারণে ট্রেনের শব্দ শুনতে না পাওয়ায় ৭৬ জন এবং স্বাভাবিক, অসুস্থতাজনিত, বার্ধক্যজনিত, আত্মহত্যা ও মানসিক প্রতিবন্ধিতার কারণে ১৪২ জনের মৃত্যু হয়।

চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেও (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) রেললাইন থেকে ১৬৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এসব মৃত্যুর পেছনেও রয়েছে উল্লিখিত কারণগুলো।

 

 

রেলওয়ে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, যেসব কারণে রেললাইনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ, সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কা লাগা বা কাটা পড়া, চলন্ত ট্রেনে ওঠানামা করতে গিয়ে ভারসাম্য হারানো, কানে হেডফোন বা ইয়ারফোন লাগিয়ে রেললাইন দিয়ে হাঁটা, ট্রেনের দরজার হাতলে ঝুলে যাতায়াত, রেললাইনে বসে থাকা, অসতর্কভাবে রেললাইন পার হওয়া এবং দুই বগির সংযোগস্থল বাফারে বসা।

কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে অনেক সময় সুযোগ বুঝে অপরাধীরাও রেললাইনে লাশ ফেলে যায়। অনেক ক্ষেত্রে এসব লাশ দেখে বোঝা যায় না দুর্ঘটনা না হত্যা। ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু বলে ধরে নিলে সে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার তদন্ত হবে, হত্যাকাণ্ডের নয়। এতে পার পেয়ে যাবে অপরাধী।

 
তবে হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ হলে সে ক্ষেত্রে তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

 

রেলওয়ে পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে রেললাইন থেকে পাঁচ হাজার ৩৬২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৮১ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। পরে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয় বলে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক তোফায়েল আহমেদ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, রেললাইন থেকে লাশ উদ্ধারের পর প্রথমে আলামত বিশ্লেষণ করে কী কারণে মৃত্যু হয়েছে, সেটা জানার চেষ্টা করা হয়। একই সঙ্গে পর্যায়ক্রমে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। রেলওয়ে পুলিশ সম্প্রতি মাদকদ্রব্য উদ্ধারেও সাফল্য অর্জন করছে বলে জানান তিনি।

সূত্র মতে, রাজধানীসহ সারা দেশে রেলপথের অনেক লেভেলক্রসিং অরক্ষিত ও অননুমোদিত। এর মধ্যে কোনোটিতে নেই গেটম্যান ও সিগন্যাল বার। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছে মানুষ। 

রেলওয়ে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রেললাইন দিয়ে কেউ রাস্তা বানালে সেটা যে প্রতিষ্ঠানই হোক, তাদের দায়িত্ব হলো রেল বিভাগ থেকে অনুমতি নেওয়া। সেভাবে রেল বিভাগ লোকবলসহ অন্যান্য বিষয় দেখে অনুমোদন করাবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রেলওয়ের লেভেলক্রসিং অরক্ষিত। এখানে নিরাপত্তার কথা ভাবা হয়নি।

রেলওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি সরদার তমিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রেলওয়ে পুলিশের প্রতিটি সদস্য সর্বোচ্চ পেশাদারির সঙ্গে কাজ করছেন। রেললাইন থেকে উদ্ধার করা প্রতিটি লাশের ময়নাতদন্ত হয়। যদি ময়নাতদন্তে হত্যাকাণ্ডের আলামত পাওয়া যায়, তাহলে হত্যা মামলা ও তদন্ত করা হয়। 

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে খুনের পর অপরাধের দায় এড়াতে লাশ রেললাইনে ফেলে রাখছে দুর্বৃত্তরা। তাদের মূল উদ্দেশ্য খুনের ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইনে হাঁটাহাঁটি করা বা রেললাইনে বসে গল্পগুজবে মশগুল থাকায় অনেকে ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এসব বিষয়ে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও রেল পুলিশ যৌথভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করতে পারে। তবে জনগণকে আরো সচেতন হতে হবে।